• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জে ইসি!

সংগৃহীত ছবি

নির্বাচন

আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জে ইসি!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০২২

গণতন্ত্রে ভোট বা নির্বাচন মানে উৎসব। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশে ভোটের উৎসব হারিয়ে গেছে। এখন কোনো ভোটেই আশানুরূপ ভোটার উপস্থিতি দেখা যায় না। ভোটের রাজনীতির চিত্র ক্রমেই বিবর্ণ থেকে হচ্ছে বিবর্ণতর। ভোটব্যবস্থায় পরপর দুটি বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

এ অবস্থায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখী হওয়ার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা-প্রতিকূলতা বিরাজ করছিল, সেসব বিষয়ের নিরসনে চ্যালেঞ্জে নেমেছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটার ও প্রার্থীদের আস্থা অর্জন করে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সর্বজনগ্রহণযোগ্য করার প্রত্যয় ইসির। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও র্শীষ রাজনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে এই ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। তাই রাজনৈতিক ‘দ্বন্দ্ব’ সামলে সব দলকে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন নির্বাচন কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

এদিকে গতকাল রোববার থেকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের কর্মপদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এ সংলাপ চলবে ৩১ জুলাই পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের প্রথমদিন গতকাল আলোচনা হয়— জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ ন্যাশনালস্টি ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ কংগ্রেস ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সঙ্গে।

সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে পদ ছেড়ে চলে যাব। আমাদের অনুরোধ করতে হবে না। আমরা আমোদ-ফুর্তি করতে আসেনি। এ নিয়ে বিএনপিসহ কোনো রাজনৈতিক দলের চিন্তা করতে হবে না। সকল বিতর্ক এড়িয়ে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে সবার মতামতের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এ সময় তিনি সকল দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে অনিয়ম ও পেশিশক্তির প্রভাব কমবে।

হাবিবুল আউয়াল বলেন, একটি দল ৩০০ আসনে এককভাবে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে সেটা গণতন্ত্র না। এর ফলে স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নির্বাচনে রাজনৈতিক ঐক্য দরকার। ঐক্য গঠনে যেকোনো অরাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অবদান রাখতে পারেন বলে মনে করেন সিইসি। 

ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন আছে। এগুলো নিরসনে কাজ করা হবে। এ সময় তিনি আরো বলেন, কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কাজ করছে না। কারো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার মানসিকতা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। মাঠের সহিংসতা বন্ধ করার দায় ইসির নয় রাজনৈতিক দলগুলোর। ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনের দায় বর্তমান কমিশনের নয়। সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা না করলে নির্বাচনের পরিণত ভয়াবহ হতে পারে বলে জানান তিনি। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশনসহ গোটা নির্বাচনব্যবস্থা আস্থার সংকটে পড়েছে। আর সে সংকট হচ্ছে গভীর থেকে গভীরতর। নির্বাচন নামের ব্যবস্থাটির সঙ্গে এর মূল অংশীজন ভোটারদের সংযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে। ফলে গণতান্ত্রিক সমাজের প্রথম ধাপ নির্বাচনই এখন বড় প্রশ্নের মুখোমুখি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জনগণ নিজের ভোট নিজে দিতে পারাকে এক ধরনের অধিকার আদায় বলে বোধ করতেন। সারা বছরের লাঞ্ছনা-বঞ্চনার একটি প্রতিশোধ হিসেবে নির্বাচনকে বেছে নিতেন। নির্বাচনের পর তাদের সব মুশকিলের আসান হতো না বটে, তবে তারা আরেকটি নির্বাচনের অপেক্ষায় থাকতেন। রাজনীতিকরাও মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথা বলে ভোট চাইতেন।

রক্তের বিনিময়ে হোক কিংবা যুদ্ধের বিনিময়ে, রাষ্ট্র ও সরকার কীভাবে কার দ্বারা পরিচালিত হবে-এ বিষয়ে বাংলার জনগণের প্রত্যক্ষ মতামত ছিল। সেই মতামতের গুরুত্বকে উপলব্ধি করেই নির্বাচনিব্যবস্থা। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ৫৫ শতাংশ ভোটার তাদের মতামত প্রকাশ করেন ভোটের মাধ্যমে। তার পরের তিনটি নির্বাচন একতরফার দোষে দুষ্ট। দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসনের পর বলা যায় যে, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জনগণের মাঝে আবারো উৎসাহ ফিরে আসে। সে নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

১৯৯৬ সালে এই উপস্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ দশমিক ৫৯ শতাংশে এবং ২০০১ সালে অঙ্কটা দাঁড়ায় ৭৫ দশমিক ৫৯ শতাংশে। ভোটারের উৎসবমুখর পরিবেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। সে নির্বাচনে ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোট উৎসব দেখা যায়নি।  যদিও ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত চারটি নির্বাচন নিয়ে ‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল’ কারচুপির যত অভিযোগই উঠুক না কেন, ভোটারদের মনে কোনো ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়নি। ভোটারদের সেই স্বতঃস্ফূর্ততার যথাযথ মূল্যায়ন করতে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট প্রদানের ভেতর দিয়ে বিজয়ী হলো সেই আওয়ামী লীগ তার পরের দশম নির্বাচনে জনগণের ওপর আস্থা রাখতে পারল না। দলীয় সরকারের অধীনে একতরফাভাবে নির্বাচন করল এবং ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ৪০ দশমিক ০৪ শতাংশ। মানুষ ভোটের জগৎ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলেন। সে পথ ধরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বলা যায় মানুষের ভোটাধিকারকে অভিনব পন্থায় হরণ করা হলো। যে নির্বাচন মানুষের কাছে একটি অন্যতম উৎসব ছিল, সে নির্বাচন পরিণত হলো একটি ‘খেলো’ আয়োজনে।

বিএনএফের প্রেসিডেন্ট মুক্তিযোদ্ধা এস এম আবুল কালাম বলেন, শুরু থেকেই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবিলা করতে হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে রাজনীতির হিসাবনিকাশ অনেক কঠিন হবে বলে আমাদের ধারণা। দেশে সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ইসির ভাবমূর্তি পুনরোদ্ধারে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম বলেন, এই নির্বাচন কমিশন প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল হয়েই থাকবে। আজ দেশে জনগণের ভোটের অধিকার নেই। এখন আইন করে তা ছিনতাই করা হয়েছে। এখন ভোটের কেন্দ্র পাহারা দিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার কায়েম করতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগের আনুগত্য ইসি দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের সামনে প্রশাসন বা সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। তাই বর্তমান সরকারের অধীনে ইসি সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে কি-না তা নিয়ে শঙ্কা আছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। সকল ক্ষেত্রে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, রাজনীতিবিদদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। তাই দেশের জনগণের কাছে কারো জবাবদিহিতা নেই। জাতীয় পার্টি আবারো প্রহসনের নির্বাচন চায় না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইসির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য ডাকা হলে, আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংলাপে অংশ নেবো।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনিব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি নানা কারণে ভেঙে পড়েছে। এই ভেঙেপড়া নির্বাচন পদ্ধতিকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস করে এবং নির্বাচনের প্রতি জনআস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে বর্তমান ইসির জন্য আগামী দিনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর যদি তারা তা করতে ব্যর্থ হন- তাহলে ফলাফল কারো জন্যই সুখকর হবে না। তবে আগামী নির্বাচন নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে ইসির এ সংলাপ অনেকটা ইতিবাচক বলে তিনি মনে করেন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে কোনো নির্বাচন কমিশনই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। এই নির্বাচন কমিশনের কোনো ক্ষমতা নেই। কী হবে তাদের সঙ্গে সংলাপ করে। সরকার পরিবর্তন না হলে কোনো লাভ হবে না। সেজন্য বিএনপি ইসির কোনো সংলাপে বা আলোচনায় যাবে না। 

তিনি বলেন, মূল প্রশ্ন হলো সরকার। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগও দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। তাই এ সংকট সমাধানে আওয়ামী লীগকেই উদ্যোগ নিতে হবে। সব দাবিকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ নিজের মতোই পথ চলছে। এ নির্বাচন কমিশন তাদের সাজানো পথেই চলছে। কিন্তু ভোটের অধিকার আদায়ে জনগণ এবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে ছাড়বে।

সম্প্রতি কুমিল্লার নির্বাচন পরিচালনা ব্যবস্থা থেকে ইসির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা চুনোপুঁটিদের আচরণবিধি মানানোর বিষয়ে কঠোর হলেও রাঘববোয়ালদের বিষয়ে কঠোর হতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জনগণ চায় এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হোক। তাই নির্বাচন কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা না ফিরলে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কখনই সম্ভব নয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads