শঙ্কামুক্ত জীবনযাপন নাগরিক অধিকার। নগরজীবনকে আশঙ্কামুক্ত করতে রাষ্ট্রের নিঃশর্ত দায়িত্ব রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। জনগণের জন্য গণতন্ত্র, আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দল, জোট ও রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের জান-মাল রক্ষা করা। নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। নগরজীবনকে শঙ্কামুক্ত করা। নাগরিকের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করা। নগরজীবন অস্থিরতায় পড়ুক সেটা শান্তিকামী জনগণের কাম্য নয়। কিন্তু কেন জানি জাতীয় নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই জনজীবন অস্থির হয়ে উঠছে। অস্থিরতা বাড়ছে রাজনীতিতে, দলে দলে এবং জোটে জোটে। এর গ্লানি নিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। ভোটের আগে জোটের রাজনীতি দেখা যায়। জোটের রাজনীতিতে ভোটের হিসাব-নিকাশ করা হয়। রাজনীতি এবং ভোটকে নানাভাবে হিসাব-নিকাশ করে জয়লাভের অঙ্ক কষা হয়। সে অঙ্কে কখনো কখনো ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যায়। সে গন্ধে জনগণের জান মাল ইজ্জতের ক্ষতি থাকে। ষড়যন্ত্রের জাল এতই বিস্তার হয় যে, ওই জালে জনগণ হাজারো দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমান নির্বাচনকে সামনে রেখে মনে হয় যেন সে খেলাই চলছে।
এখন বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক সবগুলো দল ও জোটের মধ্যে ভাঙন চরমভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। যারা ভুলেও রাজনীতির কথা বলে না, তাদের মধ্যেও ভাঙন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে মাঠছাড়া করছে। একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাচ্ছে। নিজের দলকে শতভাগ বিশুদ্ধ বলছে, অন্যদের বিরুদ্ধে ইচ্ছামতো সমালোচনা করছে। ধর্মীয় দলের মধ্যে এসব হানাহানি ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দূরত্ব এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই যাদের ওঠাবসা ছিল একত্রে এবং এক বাসনেই যারা আপ্যায়ন করেছিল, তাদের আচরণে ক্ষুব্ধ হচ্ছে সাধারণ অনুসারীরা। আরেকটি ধর্মভিত্তিক অরাজনৈতিক দাবি আদায়ের সংগঠন, তারাও আজ রাজনীতির বেসামাল বক্তব্যে দ্বিধাবিভক্ত। তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা লাখ লাখ সতীর্থ এখন দল-উপদলে উচ্ছৃঙ্খল। যাদের কর্মসূচি ছিল অরাজনৈতিক ধর্মভিত্তিক দাবি আদায়, তাদের মধ্যে বিভক্তিতে অনেকটা হতাশ ধর্মানুসারীরা। তাহলে বলা যায়, রাজনীতি, ধর্ম, অরাজনৈতিক সব দল এবং জোট এখন একযোগে বিভক্ত। মানুষের ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে এটা আরেকটি গভীর সঙ্কট। সব দলেই বিভক্তির আওয়াজ। ষড়যন্ত্র আর অস্থিরতার রাজনীতিতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে আগামী দিনে বাংলাদেশের জনগণের জন্য রাজনীতির কী সুখবর? সব দল জোট এবং শাসকের মধ্যে তাদের কথাবার্তায় যেসব বক্তব্য আসছে তা দেখে মনে হচ্ছে, এদেশের জনগণ অনিশ্চিত পথের যাত্রী।
এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। আমার ধারণা, কারো কাছে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না। যেখান থেকে প্রশ্ন, সেখান থেকে উত্তর আসতে হবে। কিন্তু সেখানেই যেন সাধারণ মানুষ ঘুরপাক খাচ্ছে। এ অবস্থায় অস্থির রাজনীতি, অস্থির সমাজ, অস্থির আগামী দিনের বাংলাদেশ। দেশের বেশিরভাগ মানুষ শান্তিপিপাসু। তারা শান্তির জন্য গণতন্ত্র চায়, শান্তির জন্য নির্বাচন এবং ভোটাধিকারের বাস্তবায়ন প্রত্যাশী। কিন্তু এ দায়িত্ব জনগণের জন্য মহান দায়িত্ব। কে পারবে পূরণ করতে জনগণের এ দায়িত্ব? আসলে এমন দল জোট ও নেতার যে প্রয়োজনীয়তা, সে প্রয়োজন পূরণ করার মতো নেতার সন্ধান চায় জনগণ। জনগণের প্রত্যাশার দল ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী কখন মিলবে, সেটাই এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। অসাম্প্রদায়িক নীতি-আদর্শের মাপকাঠিতে কতদূর এগিয়ে যেতে পারবে দেশ, সেটাই দেখার বিষয়। নাগরিক ও মানবিক অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা কার মাধ্যমে সফল হবে সে চিন্তায়ও জনগণ অস্থির। এ অস্থিরতার শেষ কোথায়, সেটারও শেষ বলা মুশকিল। পরিস্থিতি যেভাবে তৈরি হচ্ছে, মনে হয় যেন আরো কঠিন হচ্ছে। তাহলে পরিস্থিতির শিকার কি জনগণই? এভাবে স্বাধীন দেশের জনগণকে আর কতদিন আশঙ্কা এবং শঙ্কার মধ্যে থাকতে হবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। জনগণ ভোট দেবে, নির্বাচন দেখবে, সঠিক ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে যে দলেই ক্ষমতায় বসুক না কেন, সেটা জনগণের বিবেচ্য নয়। নাগরিক শান্তির স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকুক- সে প্রত্যাশাই রাখে জনগণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
mh.hoqueansari@gmail.com