ঊনসত্তর বছর বয়সে শিক্ষানুরাগী মানুষ লুৎফর রহমান দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন গ্রামে দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। বিনিময়ে তিনি একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দিনে এক টাকা করে নেন। তাই গাইবান্ধা শহর ও গ্রামের মানুষের কাছে লুৎফর রহমানের পরিচিতি এক টাকার মাস্টার হিসেবে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সোপানে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন শিক্ষাক্ষেত্রে দেশের প্রভূত উন্নতির অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে পড়া এলাকায় এমন ব্যক্তি উদ্যোগে দেশ নিয়ে নতুন আশার স্বপ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।
প্রথমে শিক্ষানুরাগী এই মহান ব্যক্তিটিকে স্যালুট জানাতে হয়। বিরল ব্যতিক্রম এমন উদ্যোগ প্রজন্মের জন্য দেশপ্রেমের নতুন বার্তা। কেননা আমরা যে অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেখানে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া কারো যেন কোনো কিছু ভাবার সুযোগ নেই। দেশ, সমাজ, পরিবারের প্রতি আমাদের দায় ও দায়বদ্ধতার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি অর্জনের কাঙাল সময়ে এসে এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমান যেন আমাদের বোধের দরজায় টোকা দিলেন।
জানা গেছে, ১৯৮৪ সাল থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ালেখায় সহযোগিতা করছেন লুৎফর রহমান। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দীর্ঘ ৩৫ বছর এলাকার গ্রামগুলোয় শিক্ষার আলো ছড়ানোর বিনিময়ে প্রতি শিক্ষার্থী থেকে দিনে চার আনা (পঁচিশ পয়সা) থেকে শুরু করে বর্তমানে ১ টাকা পর্যন্ত ভাতা গ্রহণ করছেন। একালে এমন মানবদরদী মনোভাবের কথা ভাবাই যায় না। অথচ তিনি আত্মকেন্দ্রিকতার জাল ছিন্ন করে বলতে গেলে বিনা বেতনেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
খবরে আরো জানা যায়, অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার এক টাকা দেওয়ার সামর্থ্য না রাখলেও তিনি তাদের বঞ্চিত করেন না। এভাবে এক টাকা নিয়ে বা বিনাপয়সায় পড়িয়ে প্রতি মাসে তিনি ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা আয় করে জীবন চালান। এক টাকার লুৎফর মাস্টারের এই নির্লোভ নিবেদিত শিক্ষাসেবা কার্যক্রম দেখে আমাদের শিক্ষকসমাজ কতটা শিক্ষা নেবে, সেটাও ভাবার বিষয় বটে। কেননা সরকারি-বেসরকারি প্রায় সকল পর্যায়ের শিক্ষকরা উচ্চ বেতন পাওয়ার পরও অবিবেচকের মতো কোচিং আর প্রাইভেটের অনৈতিক বাণিজ্যে অকাতরে পকেট কাটছেন অভিভাবকদের। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব শিক্ষক কি কখনো ভাবেন যে, দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি তাদের দায় এবং দায়িত্ব কি? ভাবেন না বলেই শিক্ষক হিসেবে সমাজে তাদের মর্যাদার আলোকবর্তিকাটি প্রায় নিভুনিভু অবস্থার অতলে হারাতে যাচ্ছে।
একজন লুৎফর রহমান একালে এসে এক টাকায় শিক্ষকতার যে দৃষ্টান্ত দেখালেন তা সমাজের অন্ধকার মানসিকতার মাঝে ক্ষীণ দীপশিখার প্রতীক হয়ে জ্বলে উঠুক শিক্ষিত সমাজের বিবেক ও বোধে। এই থেকে শিক্ষা নিক শিক্ষিত সমাজের মানুষগুলো। আমাদেরও যে কিছু করার আছে এই বোধ জাগরিত হোক। বিশেষত শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত যারা আছেন, তাদের মাঝেও এ চেতনার দিগন্ত উন্মোচিত হোক।
কেননা শিক্ষকতা কেবলই চাকরি নয়, একটি মহৎ সেবাও বটে। সেই সঙ্গে আমরা প্রত্যাশা করব মহৎ ও হূদয়বান এক টাকার মাস্টারের এই সেবা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সচেতন দেশবাসী ও শিক্ষা বিভাগের সবাই সহযোগিতার হাত বাড়াবেন।