• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাজেট ২০২০-২১

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কতটুকু সক্ষম

  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০২০

জেরিন তাসনিম

 

বিশ্বের বিভিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (২-৩)% হবে বলে অনুমান করেছে। যদিও এ বছর প্রবৃৃদ্ধি ৫.২% শতাংশে এসে নেমেছে। আর বাংলাদেশ সরকার ৮.২% হবে বলে প্রত্যাশা করছে। অথচ প্রবৃদ্ধি হলেই যে কর্মসংস্থান বাড়বে, বৈষম্য দূরীভূত হবে কিংবা জীবনের গুণগুত মান বৃদ্ধি পাবে তা কিন্তু নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আয়তন সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৩.২৪% বেশি। মোট আয়ের  লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা বিগত বছরের তুলনায় ৯.৮২% বেশি হলেও তা আদায় করা সাপেক্ষে অনেকাংশে অবাস্তব। এখানে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার, সড়ক পরিবহন, মহাসড়ক ও বিদ্যুৎ বিভাগকে। অথচ গুরুত্ব বেশি দেওয়া উচিত ছিল স্বাস্থ্যখাতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার পরিচালনার ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। বিগত বছরের তুলনায় সরকারি কর্মকর্তাদের বেতনভাতা খরচ ৮% এবং ব্যবস্থাপনা খরচ ৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেখছি সরকারের ২২.৫৮% ব্যয় হয়ে যাচ্ছে এসব খাতে। ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর ন্যূনতম সীমা ৩ হাজার কোটি টাকা। সর্বনিম্ন কর ৫% নির্ধারণ করা হয়েছে। অনলাইনে কর প্রদান জনপ্রিয় করা হয়েছে।

এবছর দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানেরও উপকরণ আমদানি করার ক্ষেত্রে অগ্রিম করের পরিমাণ ৪%-৫% নির্ধারণ ও অগ্রিম কর সমন্বয় করার জন্য দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদে সমন্বয় করার সিদ্ধান্তটি প্রশংসনীয়। এডিপিতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে বিগত অর্থবছরের তুলনায় মাত্র ০.৯% বেশি। এখাতে বরাদ্দ করা হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এ সামান্য বরাদ্দ নিয়ে কীভাবে করোনা মোকাবিলায় উপকারে আসবে? অপরদিকে স্বাস্থ্যবীমা নিয়েও কোনো প্রস্তাবনা দেখা যাচ্ছে না। টেলিমেডিসিনকে যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে তারও কোনো উদ্যোগ নেই। গত এক দশক ধরে এই দেশের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট উৎসাহব্যাঞ্চক ছিল। তবে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে কখনও মুক্তি মেলেনি। এমতাবস্থায় করোনার প্রাদুর্ভাবের দরুন এই অভিশাপের ভার যেন বেড়েই চলেছে। তাছাড়া বর্তমানে প্রবাসী শ্রমিকরা চাকরির অনিশ্চয়তায় ভুগছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার চেয়ে বিদ্যমান কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বেকারত্ব দূরীকরণে তরুণদের নতুন উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদান করার সিদ্ধান্তটি সময়পোযোগী।

কৃষিখাতে ১৬ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যা সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৩ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা বেশি। ভর্তুকি ৮ হাজার ১ কোটি টাকা থেকে ৯ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা করা হয়েছে। কৃষিতে মোট কর্মসংস্থানের ৪২% জড়িত। যেখানে অধিকসংখ্যক মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত, সেখানে মাত্র মোট এডিপির ১.২% বরাদ্দ করা হয়েছে। এখাতে সর্বাধিক সুরক্ষা দিতে না পারলে কখনোই দেশের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে সড়ক ও বিদ্যুৎ বিভাগ বরাদ্দের শীর্ষস্থানে, যেখানে বরাদ্দের পরিমাণ ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। যেসব গ্যাসভিত্তিক পাওয়ার প্লান্টের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের সঙ্গে চুক্তি পুনঃনবায়ন করা হলে, আমদানি করা প্রাকৃতিক রূপান্তরিত গ্যাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, যার ব্যয় অধিক এবং এর অধিকাংশ বোঝা গ্রাহকদেরই বহন করতে হয়।

করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন বিপর্যস্ত রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান। EPB-এর তথ্যানুযায়ী চলতি অর্থবছরে ১১ মাসের ভেতরে গত অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানি কমে গেছে ১৮%। এই অবস্থায় সরকার শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ নির্ধারণ করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতনভাতার জন্য আর্থিক ও নীতিগত সহায়তা প্রদান করেছে। তবে রপ্তানি চাহিদা যেহেতু দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, ঠিক সে-সময়ে উৎস কর ০.২৫% থেকে ০.৫% করাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত? উৎস করে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। অপরদিকে, অর্থনীতিকে পুনরায় চাঙ্গা করার লক্ষ্যে সরকার এই বছরে করপোরেট ট্যাক্স হার হ্রাস করেছে তা প্রশংসনীয়। কেননা যে পরিমাণ অর্থভাণ্ডার বা ওভার ইনভয়েসিং করা হবে এবং যে পরিমাণ প্রদর্শিত বিনিয়োগ ভুয়া প্রমাণিত হবে তার উপর ৫০% হারে কর আরোপ করা হয়েছে। এতে অর্থ পাচার রোধে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অনেক কম হবে বলে প্রেডিকশন করেছে। সেখানে সরকারের প্রাক্কলন তার চেয়ে বেশি। এই মুহূর্তে ব্যবসায় অর্থায়ন অন্যতম প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ পাওয়া দুরূহ। একইভাবে বর্তমান বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি ও অর্থায়ন একটি চ্যালেঞ্জ। এত বড় বাজেট বাস্তবায়ন করা দুরূহ। যদি রাজস্ব আয় ও উন্নয়নমুখী খাতে ব্যয় না বাড়ে, কর্মসংস্থান টিকিয়ে না রাখা যায় এবং প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যবসায়ীরা প্রকৃত অংশ না পায়; তবে অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে হিমশিম খেতে হবে। কেবল প্রবৃদ্ধি বাড়লেই যে জনকল্যাণ বয়ে আনবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই ধরনের আকাশচুম্বী চিন্তা বর্জন করে জীবন ও জনমুখী বাজেট নিশ্চিত করা উচিত বলে মনে করি। তবে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঘোষিত সরকারি সহায়তা সহজতর উপায়ে ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করা গেলে সম্ভাব্য মন্দা মোকাবিলা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads