• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
আমরা অপরাধ তৈরির ক্ষেত্রে পতিত হচ্ছি কি

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

আমরা অপরাধ তৈরির ক্ষেত্রে পতিত হচ্ছি কি

  • সাঈদ চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৪ অক্টোবর ২০২০

কয়েকদিন আগে গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল শ্রীপুরের মাওনা ইউনিয়নের বারতোপা গ্রামের স্কুলশিক্ষক নেশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রাণ দিল! ছেলেটি স্কুলে শিক্ষকতা করত। খুব সাধারণ জীবন। নেশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে বলে তাকে হিংকন মাঝির পুরো দল মিলে পিটিয়ে হত্যা করল। কী নিষ্ঠুর আর নির্মম নেশার করাল গ্রাস!

এভাবেই চলছে হিংকন মাঝি নামক সমাজের কীটদের বিস্তার। কিন্তু স্কুলশিক্ষকের প্রতিবাদী প্রাণ কি ইতিহাসে জায়গা করতে পেরেছে? প্রতিবাদী নায়ক যারা এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে রয়েছেন তারা প্রত্যেকেই দেশের জন্য কাজ করে গেছেন কিন্তু যাদের এভাবে প্রাণ দিতে হয় তারা? তারা কি শুধু প্রাণ দিয়েই যাবে আর আমরা অসহায়ের মতো এমন পড়ে থাকতে দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দেব?

এর পরেই আরেকটি ঘটনা। গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনাতেই ঘটলো নৃশংস ঘটনাটি। এখানেও নেশার বিস্তারই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। একজন যুবক কুপিয়েছে  তার স্ত্রী, বাবা এবং সন্তানকে। আমরা নির্দ্বিধায় লিখে যাচ্ছি এই সংবাদগুলো। কোপানোর পর রক্ত দেখেও যুবকের নেশার টাকার কথা ভুলে যাওয়ার কোনো ধরনের চিন্তা কাজ করেনি। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনাও ছিল না! এরকম পাথর, হিংস্র মানুষগুলোই নেশার মধ্যে থেকে আমাদের সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সত্যি বলছি, ভালো কথাগুলো খারাপ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে না। চর্চাটা আমরা আমরাই করে যাই। আবার কেউ প্রতিবাদ করলে পড়ে থাকতে হয় খালের পাড়ে। পুলিশ, র্যাব নির্ঘুম রাত কাটায় আসামি ধরতে। যে বারতোপা গ্রামের স্কুলশিক্ষককে খুন করেছে সে ধরা পড়ার পর সবাই যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে খুনি ছেলেটি দামি গাড়ির সামনে বসে আছে। নেশার টাকার ঝাঁজ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। যে যুবক তার সন্তান, বাবা বউকে কুপিয়েছে সেও নাকি মানুষের মতোই দেখতে।

সবিনয় অনুরোধ, আর বাড়তে দিয়েন না। নিজের সন্তান হলেও যদি সে নেশা করে আইনের হাতে তুলে দিন। আশেপাশে লিস্টেড, আনলিস্টেড যারাই নেশার সাথে জড়িত আছে তাদের ধরার চেষ্টা করুন। এমন বিপর্যয় আরো বাড়তে থাকলে সমাজ অস্থির হয়ে উঠবে। মোবাইল ফোন আঠারো বছরের আগে বন্ধ করে দিন। মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স রেস্ট্রিকটেড করে দিন। অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিন। সময় কিন্তু নেই। আমরা অপরাধ তৈরির ক্ষেত্রে পতিত হচ্ছি দিন দিন। দ্রুত বিচার করুন। প্রয়োজনে এই বিচারগুলো আলাদা কোর্ট করে দ্রুততম সময়ে বিচার শেষ করার প্রক্রিয়া চালু করুন। অপরাধের সাথে সাথে শাস্তি হলে অপরাধ কমতে বাধ্য।

নেশা এবং ধর্ষণের অপরাধের জামিন বন্ধ করে দিন। এলাকায় মাইকিং করুন যাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেশাখোরদের ধরার জন্য জনগণ সহায়তা করেন। অস্থির সমাজ ব্যবস্থাকে স্থির করতে আইনের দ্রুত প্রয়োগের কোনো বিকল্প নেই। খুব শক্তভাবে কিছু কাজ করতে হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে কী কী কাজ হচ্ছে তা যেমন তদারকির দায়িত্বে আনা দরকার, তেমনি বিকল্প কিছু বিষয় নিয়েও ভাবতে হবে এখন। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যে কাজগুলো করছে তার সাথে কাউন্সিলিংয়ের ক্ষেত্র বাড়াতে হবে। যারা মাদক নিচ্ছে তাদের পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের দিয়ে সন্তানদের মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করানো শুরু করতে হবে। প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে সরকারের কেউ মাদক নিয়ন্ত্রণের কথা বলার চেয়েও বড় কাজে দিতে পারে সামাজিক সংগঠনগুলোকে এক করে তারপর সেখানে তাদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা। সদস্য বাছাই করে পুরো এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ বলয় তৈরি করা। যারা নতুন ন্যাশনাল আইডি কার্ড করছে, পাসপোর্ট করছে অথবা ড্রাইভিং লাইসেন্স করছে তাদের সকলের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা। এই ডোপ টেস্ট আর্মি হসপিটাল থেকে করানো হলে ভালো হয় । 

মাদক না নেওয়ার মানুষ বেশি হলেও মাদক যারা নেয় বা ব্যবসা করে এদের দেখে মানুষ ভয় পায়। এই ভয় দূর করার জন্য মাদক না নেওয়া মানুষগুলো একত্র হওয়ার প্রচেষ্টা বাড়ানোই বড় চ্যালেঞ্জ। আলাদা পুলিশ টিম গঠন করে প্রতিটি এলাকায় সামাজিক সংগঠনগুলোতে মাদক নির্মূলে বিভিন্ন কাজ বিষয়ক সভা করে করে মাদকের সাথে জড়িত সকলকে একটি নিরাপত্তাবলয়ে এনে তাদের মাদকের গ্রাস থেকে বের করে আনতে হবে। মাদকের সহজলভ্যতা কমাতে হলে শুধু ডিলার বা ব্যবসায়ীয়ের আটক করে রাখলে চলবে না। বিচারিক বিষয়টি দ্রুত শেষ করতে হবে এবং যারাই এ মামলায় প্রমাণিত আসামি হবে তাদেরই শান্তি এমনভাবে দিতে হবে যাতে তারা আর অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে সাহস না পায়।

মাদকের ভয়াল থাবা দিন দিনই আমাদের গ্রাস করছে। কিশোর গ্যাং নামক আজ যে একটি বড় সমস্যার দিকে এগুচ্ছি আমরা তার পেছনেও বড় ভূমিকা রাখছে মাদক। সাভারে স্কুলছাত্রী যাদের দ্বারা খুন হলো তারাও কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য বলেই সংবাদ আসছে। অর্থাৎ প্রথম মাদক নেওয়া, তারপর আস্তে আস্তে সবার মধ্যে বিস্তৃত করার প্রয়াশ থেকেই একেকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। যার ফলে এরা বেশিরভাগ সময়ই হিংস্র হয়ে উঠছে আর এর ফলে প্রাণও যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ।

সামাজিক চিন্তা থেকেই আমাদের এখন নেশার বিরুদ্ধে কাজগুলো বাড়িয়ে এদের সামাজিকভাবে শৃঙ্খলে রাখা প্রয়োজন। এজন্য সরকারের সাথে সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে সবাই এক হয়ে কাজ করেতে হবে। বারতোপা গ্রামের শিক্ষক নেশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে প্রাণ হারিয়েছেন। এক স্কুলশিক্ষকের এমন মৃত্যু দেখে রাষ্ট্রযন্ত্র তাদের একটি দৃঢ় পদক্ষেপ ঘোষণা করে একটি নেশামুক্ত সমাজ গঠনে আরো গতিশীল ভূমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা।

 

লেখক : সদস্য, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, শ্রীপুর, গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads