• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
করোনা সংকটে শিক্ষার্থীদের করণীয় ও বর্জনীয়

ছবি : প্রতীকী

সম্পাদকীয়

করোনা সংকটে শিক্ষার্থীদের করণীয় ও বর্জনীয়

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ০৫ অক্টোবর ২০২০

করোনাভাইরাস আজকের বিশ্বে একটি মহামারীর নাম, আতঙ্কের নাম, স্থবিরতার নাম। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আজ কাঁপছে সারাবিশ্ব, স্থবির হয়ে পড়েছে গোটাবিশ্ব, মুখ থুবড়ে পড়েছে বিদ্যার আধার; বিদ্যাপীঠ। কোটি কোটি শিক্ষার্থী যারা বিদ্যা আহরণের জন্য রাত পোহালেই ছুটে যেত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, আজ তারা চার দেয়ালের মাঝে বন্দি। এ যেন বিদ্যানামক আলোকবর্তিকা চার দেয়ালের কুঠুরিতে চাপা পড়েছে। বিদ্যার যে লেলিহান শিখা সভ্যসমাজ বিনির্মাণে আলো ছড়ায় সে শিখা আজ বায়ুশূন্য, মুমূর্ষু।

আমরা সকলেই জানি, করোনাভাইরাসের সূচনা হয়েছে এশিয়ার দেশ চীন থেকে। শুরুতে অনেকেই বলেছিলেন, করোনাভাইরাস চীনের সৃষ্টি; কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এই ভাইরাসটি। অবশ্য চীন বরাবরই বলে আসছে, কৃত্রিম নয় বরং প্রাকৃতিকভাবেই এই ভাইরাসের সৃষ্টি, যা কতিপয় দেশ ও বিজ্ঞানী মানতে নারাজ। প্রকৃতপক্ষে চীন এই ভাইরাস সৃষ্টি করেছে এমন কোনো প্রমাণ বিশ্বের কোনো দেশ বা বিজ্ঞানী আজ অবধি দিতে পারেনি। তাই ধরেই নেওয়া যায়, চীনের কোনো ল্যাবের নয় বরং কোনো প্রাণী বা জন্তু থেকেই প্রকৃতিগতভাবেই করোনাভাইরাসটির উৎপত্তি।

করোনাভাইরাস প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি হয়েছে, এর সপক্ষে কিছু যুক্তিও দেওয়া যায়। যুগে যুগে এই বিশ্বের বুকে অনেক মহামারীই প্রাকৃতিকভাবে উৎপত্তি লাভ করেছে। যেমন— সার্স, ইভোলা, প্লেগ বা এরকম আরো অনেক রোগ। আবার বলা যায়, সৃষ্টিকর্তা মানুষের ঈমান ও আমল পরীক্ষার জন্য ধরিত্রীর বুকে নানান রকমের বালা-মুসিবত প্রেরণ করে থাকেন। এগুলো বিভিন্ন নবী-রাসুলের জীবনী ইতিহাস পর্যালোচনা করতে জানা যায়।

করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েনি এমন দেশ বিশ্বে খুবই কম। হয়তো দু-একটি দেশ বাদে বিশ্বের সকল দেশ আজ এই ভাইরাসজ্বরে ভুগছে। যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অন্যভাবে বললে, বলা যায় শিক্ষার্থীদের ওপর পড়েছে এর প্রকট প্রভাব। আমাদের বাংলাদেশেও করোনার প্রভাব প্রকট। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যমতে, করোনাক্রান্তের শীর্ষ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৫তম। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে করোনাক্রান্তের হার দ্রুত কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। হয়তোবা জনসংখ্যার আধিক্য এর অন্যতম কারণ।

গত বছরের শেষ নাগাদ চীনের ওহান নামক প্রদেশ থেকে করোনাভাইরাসের সূচনা হলেও এ বছরের মার্চের শুরুর দিকে আমাদের দেশে করোনাক্রান্ত রোগী শনাক্ত হতে শুরু করে এবং ১৭ মার্চ বা এর কিছু আগে-পরে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই মার্চ থেকে শুরু করে এখনো আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। সেপ্টেম্বর মাস চলে গেছে। অক্টোবরেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে বলা যায়, শিক্ষার্থীদের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে এবং আরো হবে। দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক দারুণভাবে হতাশ। সরকারও চায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে খোলার জন্য, কিন্তু তারাও নিরুপায়। কারণ, করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে আসার আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

তবে যে যাই বলুক, আমার ধারণা, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় বাসায় বসে থাকতে থাকতে একেবারেই বোরিং হয়ে পড়েছে। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে বাসায় পাঠ্যপুস্তকে মন না বসাটাই স্বাভাবিক। পড়তে মন চায় না, এটা চরম সত্য কথা। শিক্ষকরাও প্রিয় প্রতিষ্ঠানে না যেতে পেরে কিংবা প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের সান্নিধ্য না পেয়ে হতাশ। আর অভিভাবকরা তাদের প্রিয় সন্তানকে নিয়ে আছেন মহাচিন্তায়। যারা ছোট তাদের ঘরে আটকিয়ে রাখা কঠিনসাধ্য কাজ। আর যারা বড় তাদের নৈতিকস্খলনের ভয়। এজন্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা অভিভাবক প্রত্যেকেই তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছে— কখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সরকারি নির্দেশনা পাওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশানুরূপ না কমায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আশু খোলার সম্ভাবনা নেই। এ বছর বা করোনার টিকা না আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে কি না এ ব্যাপারে আমরা গভীর অন্ধকারে আছি।

এই অবস্থায় শিক্ষার্থীরা যাতে মানসিক কোনো সমস্যায় না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। যাদের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা বা শারীরিক ব্যায়াম করার যথেষ্ট সুযোগ নেই, তারা বাসায় শরীরিক ব্যায়াম করতে পারে। আর যাদের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা বা শারীরিক ব্যায়ামের সুযোগ আছে তারা সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারে। তবে, মনে রাখতে হবে খেলাধুলা বা শারীরিক ব্যায়ামের নামে বাইরে গিয়ে যেন আমরা নিজের ও পরিবারের জন্য কোনো বিপদ ডেকে না আনি।  আমরা জানি, অনেক স্কুলেই অনলাইন ক্লাস চলছে, যাদের জন্য এই ক্লাসগুলো প্রযোজ্য তারা এসব ক্লাস ঠিকমতো অনুসরণ করে তদানুযায়ী প্রস্তুতি নিতে পারে। আর যাদের অনলাইন ক্লাস নেই, তারা বাসায় নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। অবশ্য সারাক্ষণ পাঠ্যপুস্তকের পড়া পড়তে ভালো লাগে না বা পড়তে ইচ্ছে করে না, এটিও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে, পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল বই, যেগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক উৎকর্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিনোদন দেয়, এমন বই পাঠ করা জরুরি। তাহলে হয়তো দেখা যাবে দীর্ঘক্ষণ পড়ার যে এক ঘেয়েমি— এটা থাকবে না। একটা কথা অবশ্যই মনে রাখা দরকার বলে মনে করছি তা হলো, এখন শিক্ষার্থীদের অনেক সময় হাতে আছে, যেহেতু প্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই এই সময়টাতে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়া অবশ্যই উচিত। কারণ একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ক্ষতি করতে পারে এমনকি একজন ভালো বন্ধুও আরেকজন বন্ধুর ক্ষতির কারণ হতে পারে, কিন্তু একটি ভালো বই কখনো কারো ক্ষতির কারণ হতে পারে না।

আমরা যদি আশি বা নব্বই দশকের শুরুর দিকে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব, তখনকার সময়ে ঘরে ঘরে বিনোদনের এত মাধ্যম ছিল না, এখন যতটা আছে। তখন সুশীল সমাজের বিনোদনের মাধ্যমই ছিল সৃজনশীল বই। এই সৃজনশীল বই পড়ে প্রাপ্ত জ্ঞানের দ্বারা মানুষ চিত্তকে বিকশিত করতে পারত। সুতরাং করোনাকালীন মানসিকভাবে পর্যুদস্ত শিক্ষার্থীরা আকাশ-সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে সৃজনশীল বই পড়ে, করোনাকালীন সময়টাকে কাজে লাগাতে পারে। প্রমথ চৌধুরী কী বলেছেন, জানেন? তিনি বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ কখনো দেউলিয়া হয় না।’ তবে মজার ব্যাপার কি জানেন? এখন বই কিনতেও হয় না। চাইলেন বিভিন্ন স্বাদের বই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই সংগ্রহ করা যায়। পড়া যায়।

সব শেষের কথা এই, এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বর্তমান সময়ের বইবিমুখ জাতিকে জ্ঞানের আলোয় ফেরাতে হলে আপনার সন্তানের হাতে একটি ভালো বই তুলে দিন। তবেই দেশ ও সমাজ পাবে আগামী দিনের কর্ণধারকে।

 

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

moin412902@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads