• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

নো মাস্ক নো সার্ভিস

একমাত্র সচেতনতাই আমাদের সুরক্ষা

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০২০

জেগে ঘুমালে তাকে কেউ জাগাতে পারে না। শত ধাক্কালেও তার ঘুম ভাঙবে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, আমাদেরও এখন জেগে ঘুমানোর কাল। আমরাও জেগে থাকার মধ্যেই ঘুমিয়ে আছি, তাই শত শব্দ, শত কড়া নাড়াতেও আমাদের ঘুম ভাঙছে না। কোভিড-১৯ প্রসঙ্গেই দিতে হলো এই জেগে ঘুমানোর উপমা। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস নিয়ে শুরু থেকেই আমাদের মাঝে জেগে ঘুমানোর প্রবণতা ছিল। চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে যখন করোনা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, তখনই এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বলা হচ্ছিল। নানা দেশ থেকেও সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফেও আসছিল নানান পরামর্শ ও সতর্কতামূলক নির্দেশনা। করোনার ভয়াবহতা এবং এর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতায় একপর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। গত বছরের ডিসেম্বরে ভাইরাসটির উপস্থিতি মানবদেহে শনাক্ত হয়। যেহেতু এর প্রতিরোধে চিকিৎসা নেই, তাই প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সচেতনতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, অন্যের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাঁচি-কাশির সময় রুমাল বা টিস্যু ব্যবহার করা, মুখে মাস্ক ব্যবহার করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হয়। কারণ মাস্ক ব্যবহারে করোনার সংক্রমণ ঝুিঁক কমে।

সুুস্থ ব্যক্তির মাস্ক ব্যবহারের চেয়ে সংক্রমিত ব্যক্তির জন্য মাস্ক ব্যবহার জরুরি। কারণ সংক্রমিত ব্যক্তির থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এত সচেতনতামূলক বার্তা, এত নির্দেশনার পরও মাস্ক ব্যবহারের প্রতি আমাদের অনীহা। আমরা মাস্ক ব্যবহারে অধিকাংশই আগ্রহী নই। অনেকেই মাস্ক সঙ্গে রাখছেন, কিন্তু সেই মাস্কটি মুখে নয় ঝুলছে হয় তার থুতনির নিচে, অথবা তা উঠিয়ে রাখা হয়েছে কপালের ওপরে। জীবনকে সচল করার তাগিদে বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সকল প্রতিষ্ঠানই খুলে দেওয়া হয়েছে। মানুষও স্বাভাবিকভাবই ঘরের বাইরে আসছে। রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, খুব কমসংখ্যক মানুষই প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে আসছেন। প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনেই ঘরের বাইরে মানুষের উপস্থিতির হার বেশি।

শীতে করোনার প্রকোপ বাড়বে। এই শঙ্কা বিশেষজ্ঞরা ব্যক্ত করছিলেন অনেক আগে থেকেই। শীতে করোনা সংক্রমণের হার ঠেকাতে বিশেষজ্ঞরা নানা পরমর্শও দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন। কিন্তু তাদের পরামর্শকেও যেন আমরা গায়ে মাখছি না। আমাদের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না করোনা সংক্রমণের হার বাড়ার কথা। তাই ঘরের বাইরে আমাদের উপস্থিতি বেড়েছে। পর্যটনসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে আমাদের উপচে পড়া উপস্থিতি সে কথাই নিশ্চিত করছে। আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব ছবি আপলোড করছি, তখন আমাদের মাঝে করোনার ভীতি নেই, আমাদের সন্তানরাও করোনায় সংক্রমিত হতে পারে সে শঙ্কা কাজ করছে না। অথচ যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রসঙ্গে আসছে, পরীক্ষা প্রসঙ্গ আসছে, তখন আমরা করোনার দোহাই টেনে আনছি। যদিও প্রসঙ্গটি ভিন্ন, তবুও উল্লেখ না করে পারা গেল না।

শীতে করোনার প্রকোপ বাড়বে, শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও। সে আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, আমাদের রাজধানীতে করোনা রোগী বাড়ছে। গত ৯ নভেম্বর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, ৮ নভেম্বর দেশে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নতুন রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েছে। এদিন মারা যান ১৮ জন রোগী এবং ১ হাজার ৪৭৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়। গত কয়েকদিন ধরেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে করোনা সংক্রমণ বাড়ার কথা আসছে। দেশে করোনা শনাক্তের পর ২৪৬তম দিন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ বিশ হাজার। অন্যদিকে মৃত্যু হয়েছে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষের। বিশ্বে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫ কোটিরও বেশি মানুষের। মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে বারো লাখ মানুষের। বর্তমানে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বেই করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। তাই অনেক দেশে আবার নতুন করে লকডাউনের কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে এর বিরুদ্ধেও জনমত রয়েছে। অর্থনীতির চাকা এরই মধ্যে স্থবির হয়ে পড়েছে। করোনার প্রথম ধাক্কাই সামলে উঠতে পারেনি বিশ্ব অর্থনীতি। কবে নাগাদ পারবে তাও অনিশ্চিত। এরই মাঝে যদি দ্বিতীয় দফা লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তাহলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। সেই শঙ্কা থেকেই দেশে দেশে দ্বিতীয় দফা লকডাউনের বিরোধিতা করা হচ্ছে।

লকডাউনের বিপরীতে, আমরা যদি নিজেরা সচেতন হই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, তাহলেও করোনা সংক্রমণ অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। সে পথেই এখন হাঁটার সময় এসেছে। কারণ জীবনের সঙ্গে সঙ্গে জীবিকাও বাঁচাতে হবে। জীবিকা না থাকলে জীবন অচল হয়ে পড়বে। এজন্যই লকডাউনের পথে না গিয়েও করোনার সংক্রমণ কমাতে উদ্যোগী হচ্ছে অনেক দেশ। নিচ্ছে নানান সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। আমাদের সরকারও সে পথেই চেষ্টা করছে। করোনা সংক্রমণ রোধে এখনো পর্যন্ত মূল তরিকা মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে নানান নির্দেশনা দিচ্ছে। শুধু সরকারি পর্যায়েই না, বেসরকারি পর্যায়ে, ব্যক্তি উদ্যোগেও যেন মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। শপিংমলে, ছোট দোকানেও যেন ক্রেতা ও বিক্রেতা মাস্ক ব্যবহার করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতেও বণিক মালিক সমিতি, দোকান মালিক সমিতিকে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি জানা গেলেও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, মাঠপর্যায়ে মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। সরকারি ও বেসরকারি অফিস, দোকানপাট, মন্ত্রণালয়, গণপরিবহনসহ বিভিন্ন সেক্টরে এখনো মাস্ক ব্যবহারের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ভীষণ শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে। উপজেলা বা জেলা শহর তো দূরের কথা, খোদ রাজধানীতেও খুব কমসংখ্যক মাস্ক পরিধানরত মানুষ চোখে পড়ে। বরং যত্রতত্র মাস্ক ছাড়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। ফলে সরকারের ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’কে শুধু প্রজ্ঞাপন ও চিঠিতেই সীমাবদ্ধ বলেও অনেকে মন্তব্য করছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও এক বিজ্ঞপ্তিতে মসজিদ, মন্দির ও গির্জায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, মসজিদে সব মুসল্লির মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের আগে অবশ্যই এ বিষয়ে মসজিদের মাইকে প্রচারণা চালাতে হবে। এ বিষয়ে মসজিদের গেটে ব্যানার প্রদর্শন করতে হবে। বিষয়গুলো মসজিদ কমিটি নিশ্চিত করবে। একইভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদেরও অবশ্যই মাস্ক পরে উপাসনালয়ে প্রবেশ করার কথা বলা হয়েছে। এবং উপাসনালয়ের প্রধান ফটকে ব্যানার প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট উপাসনালয় কমিটিকে নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, জেগে ঘুমানো, আমরা যেন সবাই সেই বাক্যের মধ্যেই আটকে আছি। আমাদের অধিকাংশই মাস্ক ব্যবহারের দিকে আগ্রহী নই। মাস্ক ব্যবহারের বিপক্ষে আমাদের যুক্তিরও অভাব নেই। মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের তরফ থেকে কঠোর হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। মাঠ প্রশাসনকেও বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আইনের প্রয়োগের কথাও সামনে আসছে। কিন্তু কোনো আইন, কোনো ভীতিই এক্ষেত্রে কার্যকর হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা সচেতন হব। করোনা প্রাণঘাতী ভাইরাস। সবার জন্য না হলেও, যাদের বয়স বেশি, যারা অন্য রোগে আক্রান্ত, যারা শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, তাদের জন্য করোনা বিপজ্জনক। এই বিপদ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি প্রয়োজন। উন্নত বিশ্ব, যাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রশংসা সব সময় আমাদের মুখে ও কলমে। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে তাদেরও কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, কী পরিমাণ নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে, কীভাবে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে, সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে তা আমাদের কারোই অজানা নয়। আমাদের সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য সীমিত। তাই প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিরক্ষাই আমাদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা। পূর্বপ্রস্তুতির মাধ্যমে আমরা যদি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারি, সেটাই আমাদের সকলের জন্য মঙ্গল হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে সাধারণ মানুষ। আমরা যদি সরকারকে সহায়তা করি, তাহলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। সরকারের পক্ষেও যে কোনা পরিস্থিতি তখন সামাল দেওয়া সহজ হবে। আমাদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থাই আমাদের প্রিয়জনদের সঙ্গে আমাদেরও নিরাপদ রাখবে।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads