• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

৭১-এর আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা

  • প্রকাশিত ০৬ ডিসেম্বর ২০২০

জোবায়ের আলী জুয়েল

 

 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। খাসিয়া নারী কাঁকন বিবি ও কাঁকেট, রাখাইন নারী প্রিনছা খে, গারো নারী সন্ধ্যারানী সাংমা, ভেরোনিকা সিমসাংসহ অনেক নারী মহান মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী ও ক্যাপ্টেন হেলাল উদ্দিনের অধীনে পরিচালিত শহীদ কোম্পানির একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কাঁকেট মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে গোয়েন্দগিরি করতে গিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তিন মাস সেনাক্যাম্পে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন নিপীড়নের পর সেনাক্যাম্পেই তার মৃত্যু ঘটে। প্রিনছা খে মূলত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সেবিকার দায়িত্ব পালন করতেন। পাকিস্তানি বাহিনী প্রিনছা খে-কে বন্দি করে। তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়। গোপনে বিষ সংগ্রহ করে পাকিস্তানি সেনাদের খাবারে তা মিশিয়ে প্রিনছা খে ১৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে মেরে ফেলেন। সারা দেশে এমন অসংখ্য আদিবাসী নারী মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ইজ্জত বিকিয়েছেন। অস্ত্র ধরেছেন পাকিস্তানি বর্বর পশুদের বিরুদ্ধে। ক্যাম্পে ক্যাম্পে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়েছেন। এমনই দুজন নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন— সন্ধ্যারানী সাংমা ও ভেরোনিকা সিমসাং।

সন্ধ্যারানী সাংমা : বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যারানী সাংমা টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর জানজালিয়া গ্রামে ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জমির মারাক। মাতার নাম রিংমি। বর্তমানে তিনি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নলচাপ্রা গ্রামে স্থায়ীভাবে বসববাস করছেন। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান সন্ধ্যারানী সাংমার মধুপুর জলছত্র মিশন স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি। অতঃপর ভূটিয়া হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। পিতা ছিলেন একজন কৃষক। মাতা আদিবাসী সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরে ও কৃষি ক্ষেতে কাজ করতেন। ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে জয় রামকুড়া খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালে নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন।

১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হলে সন্ধ্যারানী সাংমা তার দূর সম্পর্কীয় বোন ভেরোনিকা সিয় সাং-এর সাথে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার অধীনে চাপাহাতি গ্রামে পৌঁছেন। এ সংবাদ শুনে হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া নার্সিং হাসপাতালে ডাক্তার প্রেমাংকুর রায় সন্ধ্যারানী সাংমা ও ভেরোনিকা সিমসাংকে ১১ নং সেক্টরের অধীনে অবস্থিত ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালে নিয়ে আসেন। যে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন ১১ নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান ও ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়। হাসপাতালটির অবস্থান ছিল বাঘমারা ক্যাম্প থেকে ৪০০ গজ দূরে। সেই হাসপাতালে মেডিকেল ওয়ার্ড ও সার্জারি ওয়ার্ডে প্রতিদিন আহত ও রোগাক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়া হতো।

সন্ধ্যারানী সাংমা সেপ্টেম্ববর মাসের দিকে ধানুয়া-কামালপুর হয়ে জামালপুরে প্রবেশ করেন। সেখানে একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন এবং তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। শেরপুরে ২৯ দিন অবস্থান করে সন্ধ্যারানী সাংমা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেন। এরপর বকশীগঞ্জ হয়ে জামালপুরে যান এবং দুটি অপারেশনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। দুই সপ্তাহ পর জামালপুর হানাদার মুক্ত হয়। জামালপুর হানাদার মুক্ত হলে দুজন ভারতীয় সৈন্যের তত্ত্বাবধানে সন্ধ্যারানী সাংমা মধুপুরে নিজ বাড়িতে পৌঁছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ের প্রত্যেকটি ক্ষণ সন্ধ্যারানী সাংমার কাছে স্মরণীয়। একদিন বকশীগঞ্জের একটি মাঠে তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী হাসপাতারে সন্ধ্যারানী সাংমা, ভেরোনিকা সিমসাং, দুলাল মিয়া, ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়, ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নানসহ আট/দশ জনের একটি টিম কর্মরত ছিলেন। হঠাৎ তাঁবুর পার্শ্বে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিকট বোমার আওয়াজ পাওয়া যায়। তাঁবুর প্রায় কাছাকাছি বোমাটি ফাটে। অল্পের জন্য তারা সকলে রক্ষা পান।

সন্ধ্যারানী সাংমা ১৯৭৩ সালের ১৬ জানুয়ারি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার নলচাপ্রা গ্রামের চার্চিল কুবীকে বিয়ে করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি জেবিরাজ দোলন কুবী, অহিমাস সাংমা ও মঞ্জুশ্রী মৃ নামে দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী।

সন্ধ্যারানী সাংমা কলমাকান্দা এলাকায় একজন আদিবাসী নারী নেত্রী হিসেবে সুপরিচিত। ‘দৈনিক প্রথম আলো’, ‘দৈনিক সমকাল’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সন্ধ্যারানী সাংমাকে নিয়ে বিশেষ ফিচার প্রকাশ করেছে। সন্ধ্যারানী সাংমা মুক্তিযুদ্ধে গারো নারী হিসেবে ‘অনন্যা শীর্ষ দশ-২০০৮’ পুরস্কার পান।

ভেরোনিকা সিমসাং :  ভেরোনিকা সিমসাং টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার আমলীতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিশ্বনাথ চাম্বুগাং। মাতার নাম কামিনী সিমাসাং। ভেরোনিকা সিমসাং ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালে নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালে তিনি নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে হালুয়াঘাটের দিকে অগ্রসর হলে ভেরোনিকা সিমসাং ও সন্ধ্যারানী সাংমা মরিয়মনগর মিশনে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে থেকে তারা চলে যান ভারতের মেঘালয় প্রদেশের মহেন্দ্রগঞ্জ থানার চাপাহাতি গ্রামে আত্মীয়ের বাসায়।

ভেরোনিকা সিমসাং ও সন্ধ্যারানী সাংমা ভারতের চাপাহাতি গ্রামে অবস্থান করছেন জেনে হালুয়াঘাটের জয় রামকুড়া খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালের ডাক্তার ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বাঘমারা ক্যাম্পের অদূরেই ফিল্ড নার্সিং হাসপাতালটির অবস্থান ছিল। ক্যাপ্টেন আব্দুল মান্নান ও ডাক্তার প্রেমাংকুর রায় সে হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। কিছুদিন সেখানে থেকে ভেরোনিকা সিংসাং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেন।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ভেরোনিকা সিমসাং ও তাদের মেডিকেল টিম ধানুয়া-কামালপুর হয়ে শেরপুর ও জামালপুরে প্রবেশ করেন। শেরপুর ২৯ দিন অবস্থান করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন। জামালপুরের বিভিন্ন যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেরোনিকা সিমসাং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদানরত অবস্থায় ডিসেম্বরে জামালপুর হানাদার মুক্ত হলে দুজন ভারতীয় মিত্রবাহিনীরর সহযোগিতায় বাড়ি ফেরেন।

ভেরোনিকা সিমসাং ১৯৭৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের বেড়িবাইদ গ্রামের খগেন্দ্র সাংমা ডিব্রাকে বিয়ে করেন। সেবিকা মুক্তিযোদ্ধা ভেরোনিকা সিমসাং ২০০৫ সালে ১৩ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে মধুপুরের বেড়িবাইদ গ্রামে সমাহিত করা হয়। পারিবারিক জীবনে তিনি লাকী সিমসাং, দীনা সিমসাং, দীপন সিমসাং নামে দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জননী ছিলেন।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads