• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ফেনী মুক্ত দিবস এবং কিছু কথা

  • প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০২০

ইমরান ইমন

 

 

ইতিহাস, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি সবদিক দিয়েই ফেনী বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ। আজকের স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে ফেনী জেলার অবদান, ফেনীর সূর্যসন্তানদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেনীর সূর্যসন্তানদের অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে ঝকঝক করছে।

বর্তমান ফেনী জেলা একসময় মহকুমা ছিল। ফেনী জেলার উৎপত্তি নিয়ে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। আমাদের ফেনীর হয়েও অনেকে হয়তো বিস্তারিত এই ইতিহাস জানেন না। এবার জানা যাক- ফেনী নদীর নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম রাখা হয়েছে ফেনী। মধ্যযুগে কবি ও সাহিত্যিকদের কবিতা ও সাহিত্যে একটা বিশেষ নদীর স্রোতধারা ও ফেরি পারাপারের ঘাট হিসেবে আমরা ‘ফনী’ শব্দ পাই। ষোড়শ শতাব্দীতে কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলপুর তাঁর বর্ণনায় লিখছেন- ‘ফেনী নদীতে বেষ্টিত চারিধার, পূর্বে মহাগিরি পার নাই তার।’ সতেরো শতকে মির্জা নাথানের ফারসি ভাষায় রচিত ‘বাহরিস্তান-ই-গায়েবী’তে ফনী শব্দ ফেনীতে পরিণত হয়। আঠারো শতকের শেষভাগে কবি আলী রেজা প্রকাশ কানু ফকির তার পীরের বসতি হাজীগাঁওর অবস্থান সম্পর্কে লিখছেন- ‘ফেনীর দক্ষিণে এক ষর উপাম, হাজীগাঁও করিছিল সেই দেশের নাম।’ কবি মোহাম্মদ মুকিম তার পৈতৃক বসতির বর্ণনাকালে বলেছেন- ‘ফেনীর পশ্চিমভাগে জুগিদিয়া দেশে...।’ বলা বাহুল্য, তারাও নদী অর্থে ফেনী ব্যবহার করেছেন। আদি শব্দ ‘ফনী’ মুসলমান কবি ও সাহিত্যিকদের ভাষায় ফেনীতে পরিণত হয়েছে। ১৮৭২-৭৪ সালের মধ্যে মোগল আমলের আমীরগাঁও থানা নদীভাঙনের মুখোমুখি হলে তা ফেনী নদীর ঘাটের অদূরে খাইয়অ্যারাতে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ওই থানাটি কোম্পানির কাগজপত্রে ‘ফেনী’ থানা (ফেনী নদীর অদূরে বলে) নামে পরিচিত হয়। অতঃপর ১৮৭৬ সালে নতুন মহকুমার পত্তন হলে খাইয়অ্যারা থেকে থানা দপ্তরটি মহকুমা সদরে স্থানান্তরিত হয় এবং নতুন মহকুমাটি ফেনী নামে পরিচিত হয়। দূর অতীতে এ অঞ্চল ছিল সাগরের অংশ; তবে উত্তর-পূর্ব দিক ছিল পাহাড়ি অঞ্চলের পাদদেশ। ফেনীর পূর্বদিকের রঘুনন্দন পাহাড় থেকে কাজিরবাগের পোড়ামাটি অঞ্চলে আদিকালে শিকারি মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়েছিল। এখানকার ছাগলনাইয়া গ্রামে ১৯৬৩ সালে একটি পুকুর খননকালে নব্য প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহূত একটি হাতিয়ার বা হাতকুড়াল পাওয়া গেছে। পণ্ডিতদের মতে, ওই হাতকুড়াল প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন। বৃহত্তর নোয়াখালীর মধ্যে পূর্বদিকের ফেনী অঞ্চলকে ভূখণ্ড হিসেবে অধিকতর প্রাচীন বলে পণ্ডিতরা মত প্রকাশ করেছেন। ফেনীর পূর্বভাগের ছাগলনাইয়া উপজেলার শিলুয়া গ্রামে রয়েছে এক প্রাচীন ঐতিহাসিক শিলামূর্তির ধ্বংসাবশেষ। প্রকাশ শিলামূর্তির অবস্থানের কারণে স্থানটি শিলুয়া বা শিল্লা নামে পরিচিত হয়েছে। প্রাচীনকালে হয়তো এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও কৃষ্টির বিকাশ ঘটেছিল। ড. আহমদ শরীফ চট্টগ্রামের ইতিকথায় বলেছেন- প্রাচীনকালে আধুনিক ফেনী অঞ্চল ছাড়া নোয়াখালীর বেশিরভাগ ছিল নিম্ন জলাভূমি। তখন ভুলুয়া (নোয়াখালীর আদি নাম) ও জুগিদিয়া (ফেনী নদীর সাগর সঙ্গমে অবস্থিত) ছিল দ্বীপের মতো।  ফেনী নদীর তীরে রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বীর বাঙালি শমসের গাজীর রাজধানী ছিল। বর্তমান ফেনী জেলার পূর্ব নাম কিন্তু ‘শমসের নগর’। শমসের গাজী এখান থেকে যুদ্ধাভিযানে গিয়ে রৌশনাবাদ ও ত্রিপুরা রাজ্য জয় করেন। তিনি চম্পক নগরের একাংশের নামকরণ করেছিলেন জগন্নাথ সোনাপুর। ১৯৮৪ সালে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের মাধ্যমে যেসব মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয়েছিল, ফেনী জেলা তার মধ্যে একটি। জেলাটির আয়তন ৯২৮.৩৪ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৮৪ সালের আগে এটি নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা ছিল। এ মহকুমার গোড়াপত্তন হয় ১৮৭৫ সালে মিরসরাই, ছাগলনাইয়া ও আমীরগাঁওয়ের সমন্বয়ে। প্রথম মহকুমা প্রশাসক ছিলেন কবি নবীন চন্দ্র সেন। ১৭৭৬ সালে মিরসরাইকে কর্তন করে চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রথম মহকুমা সদর দপ্তর ছিল আমীরগাঁওয়ে। ১৮৮১ সালে তা ফেনী শহরে স্থানান্তরিত হয়।

ফেনীর গোড়াপত্তনের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অবদান অনস্বীকার্য। সমগ্র বাংলাদেশ পাক-হানাদার মুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর, কিন্তু ফেনী পাক-হানাদার মুক্ত হয় ৬ ডিসেম্বর। এজন্য ৬ ডিসেম্বর ‘ফেনী মুক্ত দিবস’ পালিত হয়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ফেনীর মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে তিন দিক থেকে রয়েছে ফেনীর সীমান্ত। ফলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফেনীতে ব্যাপক অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। ফেনী সীমান্তে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে শুভপুর ও বিলোনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ফেনী মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম আবদুল মালেক (যুদ্ধকালে বিএলএফের প্রেসিডেন্ট) ও মরহুম খাজা আহমদের নেতৃত্বে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধারা দেরাদুন ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স)-এর ফেনী মহকুমা কমান্ডার হিসেবে ভিপি জয়নাল ফেনীর পশ্চিমাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। ফেনী অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম ভারতের বিলোনিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে অভিযান চালান। মুক্তিবাহিনী বিলোনিয়া, পরশুরাম, মুন্সিরহাট, ফুলগাজী হয়ে যুদ্ধ করে এগুতে থাকলে পর্যুদস্ত হয়ে পাক-হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তায় এবং অপর অংশ শুভপুর ব্রিজের ওপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। জাফর ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিলোনিয়া যুদ্ধ একটি অনন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। পাক-হানাদাররা ৫ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে গেলে ৬ ডিসেম্বর ফেনী হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এতে জেলাবাসী লাল সবুজের বিজয় নিশানা উঠিয়ে ফেনী শহর ও গ্রামগঞ্জে আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জনকে বীরউত্তম, ৭ জনকে বীরবিক্রম এবং ২০ জনকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেকগুলো রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীরহাটের মুক্তারবাড়ী, বন্ধুয়া ও বিলোনিয়া প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাসখ্যাত হয়ে আছে। এ রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরের যুদ্ধ-কৌশল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিগুলোতে পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা এ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অহংকার আর গর্বের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা ফেনী সরকারি কলেজ, তৎকালীন সিও অফিসসহ কয়েকটি স্থানে স্বাধীনতাকামী নিরীহ বাঙালিদের নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। সেই অমর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে ফেনী সরকারি কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ ও জেল রোডের পাশে বীর শহীদদের নামের তালিকাসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এবং বিলোনিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য ফেনীর সূর্যসন্তান যারা জীবনের মায়া ভুলে গিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন তাদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

মুক্তিযোদ্ধাদের মহান আত্মত্যাগের কথা স্মরণে রেখে বিভিন্ন উপজেলায়, অঞ্চলভেদে মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রাস্তাঘাট, কালভার্ট, সেতু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা চাই। ‘ফেনী মুক্ত দিবস’-এ একটি বিষয় ভাবনায় উদয় হয়— ফেনীসহ দেশের অন্য জেলার প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সঠিক মূল্যায়িত হচ্ছেন কি না! গণমাধ্যমে আমরা প্রায়ই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাই। এসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সরকার প্রদত্ত ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ঠিকই পায় কিন্তু মাঝখান দিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হন। দেখা যায় দেশ স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বর্ষে পা রাখলেও এখনো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সরকারি তালিকায় আসেনি। তাই এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দায়িত্বশীল মহলকে দ্রুত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে তাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads