• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

পদ্মা সেতু : জাতীয় ঐক্যের নিদর্শন

  • প্রকাশিত ১৩ ডিসেম্বর ২০২০

মুশফিকুর রহমান ইমন

 

 

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের কথা। সংবাদপত্রের পাতা  উল্টাচ্ছিলাম। হঠাৎই একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল। পদ্মা সেতুর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানো হচ্ছে। শিরোনাম দেখেই খবরটার ভেতরে প্রবেশ করলাম। বিস্তারিত পড়ার পর জানতে পারলাম সবমিলিয়ে এরকম ৪১টি স্প্যান বসানো হবে ৪২টি খুঁটির ওপর। প্রতিটি স্প্যানের দূরত্ব ১৫০ মিটার। এরকম একটার পর একটা ধাতব স্প্যান জোড়া দিয়েই তৈরি হয়ে যাবে পুরো আস্ত একটাটিদ্মা সেতু! প্রথম স্প্যানটি বসানোর পর থেকেই তাই দেশবাসী অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে, কবে বসানো হবে পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি যার মাধ্যমে জাতির সামনে দৃশ্যমান হবে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের দেশের সর্ববৃহৎ স্বপ্নের পদ্মা সেতুটি! দেশের সব উৎসুক জনতার মতো আমিও পদ্মা সেতু নিয়ে বেশ আগ্রহী ছিলাম। তাই প্রতিটি স্প্যান বসানোর পরপরই মনে হতো স্বপ্নের পথে যেন আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ৪১তম স্প্যানটি বসানোর খবর পেয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এখন দৃশ্যমান সেতুটির ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার।

জাতি হিসেবে আমরা যে নিজের সামর্থ্যে পদ্মা সেতুর মতো একটা মেগা প্রজেক্ট সফলভাবে শেষ করার সাহস দেখিয়েছি, সেটা জাতীয়তাবাদের শক্তি ছাড়া সম্ভব হতো না। যে পদ্মা সেতু নিয়ে এত আলোচনা, সমালোচনা ও গুঞ্জন ছিল, অবশেষে সব বাধা পেরিয়ে সেটি বাস্তবায়নের মুখ দেখতে যাচ্ছে এই মুজিববর্ষের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই! জাতি হিসেবে এটি আমাদের জাতীয় ঐক্যেরই নিদর্শন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে জাতির জন্য এর থেকে বড় উপহার আর কিছুই হতে পারে না।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল এই পদ্মা সেতু। সেই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ২০০১ সালের ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর পদ্মায় অনেক পানি গড়ালেও শুরু করা যায়নি পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আবারো সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নিয়োগ করা হয় পদ্মা সেতুর ডিজাইন কনসালট্যান্ট। ২০১০ সালে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর ঘটনাবহুল সময় পেরিয়ে যায়। পদ্মা সেতুর মূল দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক নানা টালবাহানার পর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল করে। একই পথ অনুসরণ করে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হবে এই সাহসী ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত হলেও এমন একটি বৃহৎ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে নানাবিধ অনিশ্চয়তা ও প্রশ্ন দেখা দেয়। ওই সময় প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা, যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। বিভিন্ন কুচক্রী মহল থেকে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছুড়ে দেওয়া হয় সরকারকে লক্ষ্য করে। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যাবে এমন অনেক তির্যক মন্তব্য শোনা যায় বিভিন্ন সুবিধাবাদী মহল থেকে। অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন শেষতক পদ্মা সেতুর কাজ হয়তো পুরোপুরি শেষ হবে না। কিন্তু বাংলাদেশ সেসব শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে। ২০১৭ সালে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়েই দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করার পরেও সংশয়বাদীদের বিরূপ মন্তব্যের কমতি ছিল না। এরই মধ্যে ২০১৯ সালের দিকে পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া গুজবে আরো ন্যক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু এত বাধা-বিপত্তি, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও চলতে থাকে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ।

যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত যোগাযোগ কাঠামোর প্রভূত উন্নতি। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলেই একটি দেশ উন্নয়নের পরবর্তী ধাপগুলোতে প্রবেশ করতে পারে। পদ্মা সেতু চালু হলে প্রথমত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসাবাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলায় নতুন করে গড়ে উঠবে ভারী শিল্প কারখানা। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে। ফলে সার্বিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ১ থেকে দেড় শতাংশ বাড়বে। আর দারিদ্র্যের হার কমবে দশমিক ৮৪ শতাংশ যা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

পদ্মা সেতু শুধুই রড, সিমেন্ট ও পাথরের তৈরি নিছক একটি সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬ কোটি বাঙালির আবেগ। সম্ভাবনার এই বাংলাদেশে সমৃদ্ধ আগামী দিনের যে স্বপ্ন আমরা দেখে এসেছি এতদিন, অনেক বাধা পেরিয়ে সেই স্বপ্ন সত্যি হতে এখন অপেক্ষা শুধু কিছু সময়ের। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সামর্থ্যের ঘাটতি, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লের পিছিয়ে যাওয়ার পর পদ্মার আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলেও কোনোকিছুই শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সবশেষে বৈশ্বিক করোনার সংক্রমণের এই কঠিন সময়েও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর কাজ।

পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। একসময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বাঙালি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে জানে। পদ্মার বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি পিলারগুলো জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যের নিদর্শন হয়েই থাকবে হাজার হাজার বছর ধরে। আর সেই সঙ্গে দূর হবে নদীতীরবর্তী মানুষগুলোর অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো। প্রতিবার একটি করে স্প্যান বসানো হয়েছে, আর আমরা দিন গুনেছি নতুন এক সম্ভাবনার। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর যেন ফুরিয়ে এলো! তারপরই হাজার হাজার বছরের দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই পাড়ের মেলবন্ধন হবে। পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাক আরেক ধাপ, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads