• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

অর্ধশতবর্ষে স্বাধীনতার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

  • মো. আখতার হোসেন আজাদ
  • প্রকাশিত ১৮ ডিসেম্বর ২০২০

বহু বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রহর গুনছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। ১২৯ ডলার মাথাপিছু আয়ের দেশটির বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। সময় পেরিয়েছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও এগিয়েছে। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতি ও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের অনুপাত তুলনা করার সময় এসেছে।

দালিলিক বা কেতাবি ভাষায় একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি সে দেশের মাথাপিছু আয়, অর্থনৈতিক অবস্থা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য, উৎপাদন, প্রাকৃতিক সম্পদ আরোহণ, ব্যাংক রিজার্ভের পরিমাণ প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) এর প্রতিবেদন অনুসারে উন্নত দেশের তালিকায় পৃথিবীর ১৫৬টি দেশের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৭তম। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সম্পদ উৎপাদন ও আরোহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বাস্তবিক অর্থে একটি দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি বা অগ্রগতি নির্ভর করে বেশকিছু নিয়ামকের ওপর, যা সাধারণত পরিসংখ্যানের নজর কাড়তে পারে না। জনগণের জীবনযাত্রার বাস্তব রূপ, খাদ্য নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মত প্রকাশের অধিকার, গুণগত মানসম্মত বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা, কর্মসংস্থান প্রভৃতির মাপকাঠি প্রকৃত উন্নয়নের চিত্র প্রদর্শন করে।

স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে তা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু প্রত্যাশিত জীবনযাত্রার মান অর্জন করা গেছে কি না এবং সর্বস্তরের মানুষের জীবনের মান পরিবর্তন হয়েছে কি না তা নিয়ে প্রায়ই চায়ের কাপে ঝড় উঠে। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা এখন বিদেশে রপ্তানি করছি। এ কৃতিত্ব বর্তমান কৃষিবান্ধব আওয়ামী লীগ সরকার ও দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের। তবে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি। ভেজাল খাবার খেয়ে প্রতি বছর তিন লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধি রোগে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকার কর্তৃক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ, আইন প্রণয়ন হলেও এর বাস্তবায়ন বড়ই হতাশাজনক। দেশে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’ নামে আলাদা সেল গঠন করা হলেও আক্ষরিক অর্থে এই কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

একটি দেশের উন্নয়নের মাপকাঠির অন্যতম পরিমাপক হলো দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিদেশী বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন, রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর ওপর নির্ভরশীল। স্বাধীনতার পূর্বে রাজনীতি যেমন আমাদের রাষ্ট্রীয় ভিত গড়ে দিয়েছে, তেমনই স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি আমাদের দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তা এক বাক্যে স্বীকার করতেই হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পণ করলেও বাংলাদেশে ক্রমাগত বিভাজনের রাজনীতি চর্চার ফলে জাতিগত ঐক্যের সৃষ্টি হয়নি। আদৌ কখনো হবে কি না তা নিয়েও শতভাগ সংশয় রয়েছে। ক্ষমতার গদি দখলের রাজনীতি চর্চার ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করে প্রায় সারাটি বছর। স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের শক্তি, মৌলবাদী গোষ্ঠী, ভারতের দালাল, চীন-পাকিস্তানের দোসর, নাস্তিক-ধর্ম বিদ্বেষীসহ বিভিন্ন ভাগে নিজেরা নিজেদের বিভক্ত করে ফেলেছি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী ও বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠীর দর্পের রাজনীতি দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিকদের বড়ই ব্যথিত করছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল আওয়ামী টানা তৃতীয় মেয়াদের একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করলেও মৌলবাদী গোষ্ঠীর রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রক্রিয়ায় নিষ্ক্রিয়তা সাধারণ মানুষকে হতবাক করছে। আবার অন্য দুটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক ভঙ্গুর দশা দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত করছে। দেশের বাম দল সমূহও বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত। শক্তিশালী বিরোধী দল যে-কোনো দেশের সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে যখনই কোনো দল ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা না করে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ গ্রহণ করে। আবার ক্ষমতার গদিতে যখন যে রাজনৈতিক দল আরোহণ করে তখন যেন বিরোধী দলকে দমন করা হয় অন্যতম প্রধান নীতি। এসব কোন নির্দিষ্ট দল নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য এমন।

একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি শিক্ষা। এটি পরিমাপের দুটি দিক রয়েছে। একটি পরিমাণগত অন্যটি গুণগত। স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি আমরা শিক্ষার পরিমাণগত দিকটিকেই আমাদের সাফল্যের মানদন্ডে মাপতে পছন্দ করে যাচ্ছি। স্বাধীনতার সময় দেশের সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ; যা বর্তমানে ৭৪.৭ শতাংশে পরিণত হয়েছে। এটিতেই আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পরিতৃপ্ত হই। বর্তমানে দেশের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলেই দেশ ভেসে যায় কথিত এ+ এর আনন্দ বন্যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, পূর্বে কেউ এ+ পেলে তাকে গ্রামের সবাই দেখতে যেত, শুভেচ্ছা জানাতে যেত। আর বর্তমানে কেউ এ+ না পেলেই তাকে দেখতে জনতা হুমড়ে পড়ে যায়। শিক্ষা ব্যবস্থায় জিপিএ এর পরিমাণকে মানদ্ল বিবেচনা করা নিরেট বোকামি ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে অভিমত দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা। দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা আরো করুণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন বেকার তৈরির ফলনশীল কারখানায় পরিণত হয়েছে। মান্ধাতা আমলের সিলেবাস দিয়ে চলছে পাঠদান। গবেষণা নেই, নেই কোনো উদ্ভাবনী সৃষ্টিশীলতা। অল্প পরিমাণে গবেষণা হলেও অভিযোগ ওঠে নকলের। আবার চাকরির বাজারের সাথে উচ্চশিক্ষা পদ্ধতির কোনোই মিল নেই। তাই শিক্ষার্থীরা প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু করে চাকরির পড়াশোনা। কোনোরকমে সার্টিফিকেটে সন্তোষজনক সিজিপিএ তোলার মতো দায়সারা পড়ালেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করছে সিংহভাগ শিক্ষার্থী। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত গবেষণা করে আহামরি এমন কিছু উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করতে পারিনি যা মানবকল্যাণে বহুলভাবে কাজে এসেছে, বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি করেছে।

কর্মসংস্থান একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম ধারক ও বাহক। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার নিয়েও প্রায়ই ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়। সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লক্ষ। এর মধ্যে আবার ৪০ শতাংশ বেকার উচ্চ শিক্ষিত। আবার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর মতে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। ক্রমেই বাড়ছে এই সংখ্যা। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া জটিল প্রকৃতির। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পরীক্ষা আয়োজনে লম্বা সময়, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা প্রভৃতির কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় চাকরিপ্রত্যাশীদের। আবার প্রায়ই এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে চাকরি লাভ বাংলাদেশে প্রায় সমাজস্বীকৃত বিষয়। নানামুখী জটিলতায় বাংলাদেশে বেকারত্বের হার বাড়ছে। কেউ হতাশ হয়ে বেছে নিচ্ছে মাদক, কেউবা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। সৃষ্টি হচ্ছে অরাজকতা। বেকারত্বে হ্রাসে সরকার থেকে উদ্যোক্তা হতে পরামর্শ দেওয়া হলেও মূলধনের অভাব ও উচ্চ হারে ঋণের ঝুঁকির ফলে যুবকরা সাহস করতে পারছে না।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা উন্মোচিত হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির ফলে এ খাতের এমন ভঙ্গুর দশা সৃষ্টি হয়েছে। মানসম্মত সেবা না পাবার ফলে একান্ত বাধ্য না হলে নাগরিকরা এখন সরকারি হাসপাতাল যায় না। স্বাস্থ্যখাতের এই অনিয়মের মহোৎসব তৃণমূল পর্যন্ত পৌঁছিয়ে গেছে; যা কঠোর হস্তে দমন না করলে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ সুযোগে চিকিৎসার নামে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছে বেসরকারি ক্লিনিকসমূহ।

শুধু চিকিৎসা খাত নয়, বাংলাদেশের প্রত্যেক খাতেই যেন দুর্নীতির কালো থাবা চেপে আছে। হয়তোবা পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে কোথাও পরিমাণে কম। দুর্নীতির এই টাকা দিয়ে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মহল অর্থের পাহাড় গড়ছে। কেউ আবার বিদেশে পাচার করছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী গত ২০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ২৮৩ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ১৪তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ২য়।

পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে পেরেছি পৃথিবীর প্রত্যেক রাষ্ট্রের সাথে। প্রতিবেশী দেশসমূহের সাথে এ সম্পর্ক আরো মজবুত। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সমুদ্র বিজয়, ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময় পররাষ্ট্রনীতির সফলতার উদাহরণ। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন, সীমান্তে  নির্বিচারে নির্ভীক হত্যাকাণ্ড, বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণ, সংস্কৃতি বিনিময়ে সমতা আনয়ন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের আরো শক্ত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে সার্বিক খাতে উন্নয়ন হয়েছে। তবে সর্বত্র সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নে ঝুঁকে পড়ার ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। দুর্নীতি দমন এবং আইনের সুশাসন নিশ্চিতকরণ সম্ভব হলে দেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads