• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জো বাইডেন

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ২২ ডিসেম্বর ২০২০

বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরে জো বাইডেন নির্বাচিত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প বার বারই নির্বাচনে ভোট কারচুপির বা জালিয়াতির অভিযোগ করেছেন। তিনি আইনি পদক্ষেপও নিয়েছেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। আদালতে তার অভিযোগ খারিজ হয়েছে। তিনি আরো একবার হোয়াইট হাউসের দৌড়ে নামার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টা সহজ হবে না। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থী রয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে উৎকণ্ঠা ছিল। গণতন্ত্রের জন্য এ কোনো শুভ ঘটনা নয়। অপেক্ষা ছিল ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের। অবশেষে সেটাও সমাপ্ত হয়েছে। এবং ইলেকটোরাল কলেজ ভোটেও বিজয়ী হয়েছেন জো বাইডেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাল এখন তার হাতেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি যে পথে নিয়ে যাবেন তা অবশ্যই জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হবে। সব ঠিক থাকলে নিয়ম অনুযায়ী আগামী ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউস ছাড়বেন ট্রাম্প। ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ছিল আনুষ্ঠানিকতার শেষ ধাপ। সেই ধাপ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এখন জো বাইডেনের হোয়াইট হাউসে যাওয়ার অপেক্ষামাত্র। নির্বাচনের পর পরাজয় মেনে নেওয়া এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করাই ছিল কাঙ্ক্ষিত; কিন্তু এবার সেটা হয়নি। ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে জয়ী হয়ে বাইডেন বলেছেন, ‘এখন সময় বদলে যাওয়ার, বদলে দেওয়ার।’ বদলে যাওয়ার এবং বদলে দেওয়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন তা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিশ্বকে বদলে দেওয়া সত্যি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিশ্বকে বদলাতে হবে ইতিবাচকভাবে। বিশ্বে একটি নেতৃত্ব প্রয়োজন যার হাত ধরে বিশ্বের সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়। সাম্প্রতিক বিশ্ব নানা সমস্যায় জড়িয়ে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সমস্যা মানবজাতির অস্তিত্বের জন্য রীতিমতো হুমকি। যার বিরুদ্ধে এখনই সজাগ না হলে নিজেদের অস্তিত্ব এই মহাবিশ্বে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে উঠবে।

বাইডেন বলেছেন, বিশ্বকে বদলে দিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। বিভেদ নয়, একতা-এই নীতিতে বিশ্বকে এগিয়ে চলা প্রয়োজন। অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়, শান্তির বার্তা পৌঁছাতে হবে। জো বাইডেন বিশ্বকে সে পথে চালনা করতে পারেন। চলমান শক্তি প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। অশুভ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্ব কোনোভাবেই কোনোদিন উপকৃত হয়নি। পরমাণু অস্ত্রের হুংকার বন্ধ হয়নি। বন্ধ হওয়া উচিত স্নায়ুযুদ্ধের নতুন সূচনার। একটি নির্বাচন, দৃষ্টি ছিল সারা বিশ্বের। আগ্রহ ছিল, অপেক্ষা ছিল আবার উৎকণ্ঠাও ছিল। জো বাইডেন একজন শান্ত, ধৈর্যশীল রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন একজন মানুষ। পৃথিবীর সামনে জলবায়ু সংকট, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আঞ্চলিক ভারসাম্য, সম্পর্ক উন্নয়ন, বাণিজ্যযুদ্ধ এসব সমস্যা রয়েছে। এসব মোকাবিলা যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমনিভাবে বাকি দেশগুলোর জন্যও। একটি নতুন বিন্যাস করতে হবে। প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে হবে। পৃথিবীজুড়ে আজ অভিবাসীর স্রোত। নানা কারণে এ স্রোত বাড়ছে। এটিও বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বাইডেন এমন এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, যখন পৃথিবী করোনাভাইরাস নামের এক দানবের হাতে ধরাশায়ী। নির্বাচনের পুরো বছরজুড়েই করোনার প্রকোপ ছিল এবং নির্বাচনেও ছিল করোনার প্রভাব। ফলে গুরুত্বপূর্ণ হলো সেখানকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। জো বাইডেন প্রথমেই করোনা নিয়ন্ত্রণের ওপর জোরারোপ করেছেন। এটাই এখন প্রথম প্রায়োরিটি। সেজন্য দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম ১০০ দিন তিনি দেশবাসীকে মাস্ক পরার জন্য বলবেন। দেশটিতে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। ফলে এখন পরিস্থিতির উন্নতি আশা করা যায়। একটি কার্যকর টিকার জন্য পৃথিবী আশা করে আছে করোনার শুরু থেকেই।

করোনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা ছাড়াও সবার জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিনের পরিকল্পনা, সবার জন্য মাস্ক বাধ্যতামূলক করা, অর্থনীতি, অভিবাসন, পররাষ্ট্রনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু ও জ্বালানি, বিচার ব্যবস্থায় সংস্কার ও কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক বিষয়ক পরিকল্পনা রয়েছে। সবকিছু ছাড়িয়ে বাইডেনের প্রথম এবং প্রধান চ্যালেঞ্জ ও কাজ হলো করোনা নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন করা। অর্থনীতিকে সচল রেখে দেশের নাগরিকদের করোনা থেকে সুরক্ষা প্রদান এবং আক্রান্ত ও মৃত্যু কমিয়ে আনতে হবে। এক কোটি দশ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা প্রদান, করোনা ছাড়াও জো বাইডেনের বিজয়ের কারণ তার ইস্যুগুলো জনগণকে টানতে পেরেছে। তিনি জনগণের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি বড় দিক হলো সুষ্ঠু নির্বাচন, নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণ এবং শান্তিপূর্ণভাবে ও নিয়মতান্ত্রিকভাব ক্ষমতা হস্তান্তর করা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকেও তার পরিকল্পনা রয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনায় তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্ক ক্রমেই এক নতুন পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। ইরানের সঙ্গে টানাপোড়েন রয়েছে। বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রশ্নে ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে বাইডেনের নীতির ভিন্নতা রয়েছে। সেই নীতিতে বিশ্বে শান্তির বার্তা আনলে তবেই সার্থকতা। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ছিল একটি আলোচিত নির্বাচন, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পরাজয় না মেনে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ আনেন। উভয়ের সমর্থকদের মধ্যে বিক্ষোভ-পাল্টা বিক্ষোভ হয়েছে। আহত হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশের কাছে যা সত্যিই অপ্রত্যাশিত।

বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্ব ইতিবাচক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছেন। সরে গেছেন ইরানের পরমাণু চুক্তি থেকেও। অথচ বিশ্বের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো জলবায়ু। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে। করোনার পরেই আমাদের যা ভাবতে বাধ্য করছে সেটা হলো জলবায়ু ইস্যু। করোনাভাইরাসের টিকা দিয়ে থামানো যেতে পারে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে থামাবে বিশ্ব তা নিয়েই ভাবতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর কাছ থেকে জোরালো ভূমিকা আশা করি। আমরা চাই তিনি দায়িত্বে এসেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফিরবেন। ফিরবেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো সেবামূলক সংস্থাতেও। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, বাইডেন দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই সম্পর্ক কী হবে? এই ভাঙন হয়তো থামবে না। কিন্তু দুই দেশের এই টানাপোড়েন ভোগাতে পারে গোটা বিশ্বকেই। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখন চলে মিত্র বা জোটবদ্ধভাবে, যেখানে একাধিক শক্তিশালী এবং আঞ্চলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশ থাকে। 

 

লেখক : সাংবাদিক

sopnil.roy@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads