• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবদান

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ২৪ ডিসেম্বর ২০২০

মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের জাতীয় বীর। তাদের চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মানুষগুলো, স্বাধীনতাকামী জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হয়েছে ৩০ লাখ মানুষ, ৩ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা বহন করে চলেছে আজো অগণিত মানুষ।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন জাতিকে রক্ষার্থে স্থির থাকতে পারেনি আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুবকরা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই দিনেই বাংলার সর্বস্তরের জনগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। প্রস্তুত হয়েছিল দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলো। রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানাতেই ৬২ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পাওয়া যায়। দিনাজপুর জেলার ওরাঁও ও সাঁওতালদের এক হাজার জনের সমন্বয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, শেরপুর, নেত্রকোনা এলাকার গারো, হাজং, কোচ জনগোষ্ঠীগুলো থেকে প্রায় পনেরোশ উপজাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১১৫ জন ছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট এলাকা থেকেই। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ জনের অধিক সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। অনেকে জীবন দিয়েছেন দেশের জন্য। তাদের মধ্যে গিরিশ সিংহ ও ভুবন সিংহ উল্লেখযোগ্য। সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার সদর, কুলউড়া, বড়লেখা, চুনারুঘাট, মাধবপুর, বৈকণ্ঠপুর, গোয়াইন ঘাট, সিলেট সদর ও ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ৮৩টি বাগান এলাকার উপজাতি ও চা জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৬০২ জন শহীদ, আহত ৪৩, নির্যাতিত ৮৩ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অনেকেই।

দেশমাতৃকার টানেই নৃ-গোষ্ঠীর মুক্তিযোদ্ধারা কর্মক্ষম হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। কোনো অংশেই তাদের অংশগ্রহণকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। শত্রুর হাতে জীবন উৎসর্গ করেছেন লড়াই করেই, শারীরিক পঙ্গুত্ব নিয়ে অনেকে জীবিত রয়েছেন। হারিয়েছেন সহায়-সম্পদসহ সবকিছুই। ধর্ষিতা হয়েছেন অগণিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী।

আমরা রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের কথা কমবেশি সবাই জানি। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ রংপুরের নৃ-গোষ্ঠী ও বীরজনতা মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর। এদিন সকাল ১০টার দিকে ক্যান্টনমেন্টের কাছে নিসবেতগঞ্জ এলাকায় সমাবেশ আহ্বান করা হয়। ভোর থেকে মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, বদরগঞ্জ, রানী পুকুর, বুড়িহাট, হারাগাছ, শ্যামপুর, লালবাগ, গঙ্গাচড়া, পাগলাপীর, তারাগঞ্জ প্রভৃতি এলাকা থেকে নৃ-গোষ্ঠীর হাজার হাজার মুক্তিপাগল জনতা লাঠি, খুন্তি, বল্লমসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সেখানে সমবেত হতে থাকেন। ওই সমাবেশে বিপুলসংখ্যক সাঁওতাল নারী-পুরুষ তীর-ধনুক, বল্লম নিয়ে সমবেত হয়। এ সময় পাক হানাদার বাহিনী বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পাকসেনারা ২০০ সাঁওতালকে হত্যা করে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সেই স্থানেই ২০০০ সালে সেনাবাহিনীর সহায়তায় নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ ‘রক্তগৌরব’।

শহীদ পরিমল দ্রং হালুয়াঘাট বিড়ই ডাকুলি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের জুন মাসের দিকে নকলা সেতু ধ্বংসের অপারেশনে যান, সেতু ধ্বংস করা হয়। পালানোর সময় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন রামনগরে। রাজাকাররা তাকে সোপর্দ করে পাকসেনাদের হাতে। প্রচণ্ড নির্যাতনের পর ফুলপুরের কংস নদীর পাড়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘোড়াঘাটের ফিলিেসর সাঁওতাল নেতৃত্বে মাইন বিস্ফোরণে পাকসেনাদের একটি রেডফোর্স মোটরকার ধ্বংস করা হয়। মিছিলকারীরা নাটোরের প্রতিটি সরকারি অফিস থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করে। এদিন নাটোরের কৃষক, মজুর, জেলে, সাঁওতালসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ লাঠি, বর্শা, তীর-ধনুক প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতার পক্ষে এক জঙ্গিমিছিল বের করে। সাঁওতাল, গারো, হাজং, চাকমা, মগ ও অন্যরা বিষমাখা তীর-ধনুক নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অমূল্য সরকার, সুরেন্দ্রনাথ সরকার, নির্মল কুমার সরকার, ধরিষা মাহাতো প্রমুখ জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাদেরও জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল একাত্তরে। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল তাদের চৌদ্দপুরুষের ঘরবাড়ি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অবদান ছিল গৌরবের।

বৃহত্তর সিলেটের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিলেট অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কয়েকজন হলেন- মুক্তিযোদ্ধা উপেন্দ্র ভৌমিক, মুক্তিযোদ্ধা অজয় বাঁউড়ি, শহীদ নিবারণ ওরাং, শহীদ রেবতী মাহালী, শহীদ শুভ্রতাতী, নারী মুক্তিযোদ্ধা লালগী খাড়িয়া, মুক্তিযোদ্ধা কুলচন্দ্র তাঁতী, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পবন কুমার তাঁতি, মুক্তিযোদ্ধা অনীল ছত্রী, মুক্তিযোদ্ধা উপেন্দ্র বাড়াইক, শহীদ কুনকুনিয়া রুদ্রপাল, নারী মুক্তিযোদ্ধা কাঁকন বিবি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠী পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে দেশরক্ষার তাগিদে প্রতিরোধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

উত্তরবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা হলেন- মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক সাগারাম মাঝি, দিনাজপুরের ফাদার মারান্ডি, নওগাঁর মুক্তিযোদ্ধা সুরেন্দ্র চন্দ্র পাহান, মুক্তিযোদ্ধা বিশ্বনাথ মাঝি, রংপুরের মিঠাপুকুরের বুদুলাকড়া, দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানার ওঁরাও মুক্তিযোদ্ধা মনাইচন্দ্র খালকো, দিনজপুরের কশবা মিশনের দশম শ্রেণির ছাত্রী নারী মুক্তিযোদ্ধা জসপিন টপ্প প্রমুখ।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত বিপ্লবী যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি সশস্ত্র প্রাথমিক প্রতিরোধ আন্দোলন। একাত্তরের প্রতিরোধ প্রাথমিক পর্যায়ে স্বতঃস্ফূর্ত ছিল এবং তা পর্যায়ক্রমে স্বাভাবিকভাবেই জনযুদ্ধে এগিয়ে যায়। পরবর্তীকালে এটি স্বাধীনতায় রূপ নেয়। আমাদের একাত্তরের মুক্তিকামী যুদ্ধের প্রতিরোধ স্বতঃস্ফূর্ত আপামর জনগণের। আবালবৃদ্ধবনিতা সব বাঙালি ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত। আপামর জনগণই ছিলেন প্রতিরোধের স্রষ্টা। বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতনের যে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ হয়েছিল, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল আমাদের রক্তাক্ত ৯ মাসের স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণা দিয়েছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনার বিকাশ ঘটেছিল আমাদের মহান ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনার লালনে জনগণ ছিল প্রচণ্ড প্রতিবাদী ও আশাবাদী। দীপ্ত আলোর মুক্তি আজাদী সংগ্রামের অতন্দ্র প্রহরী।

আমাদের দেশ ও জাতির দায়িত্ব মহান মুক্তিযুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা। মুক্তিযুদ্ধে তাদের গৌরবময় ভূমিকাকে যথাযথভাবে সম্মান জানানো। বীরদের বুকে ব্যথা থাকলে আমাদের সব আয়োজন নষ্ট হয়ে যাবে। হেলাল হাফিজের সেই চাওয়া যেন পূরণ হয়— কথা ছিল একটি পতাকা পেলে/আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে,/সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ/সকলেই নিয়ে যাবো সংসারে।

 

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads