• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

করোনাকালেও রেমিট্যান্স প্রেরণে রেকর্ড

  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০২০

এম এ খালেক

 

কয়েকদিন আগে মালিবাগে একটি বেসরকারি ব্যাংকে চেক নগদায়নের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। পাশের কাউন্টারে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রদান করা হচ্ছিল। দুজন ভদ্র মহিলার মধ্যে আলাপ হচ্ছিল। এদের মধ্যে একজন রুমানা হক বলছিলেন, তার স্বামী করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছিলেন। ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার সময় ঘনিয়ে এলেও তিনি পরিবহন জটিলতার কারণে কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারছিলেন না। পরে সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে পুনরায় সৌদি আরবে ফিরে যেতে সমর্থ হন। সৌদি আরব থেকে এক লাখ টাকা প্রেরণ করেছেন। সেই টাকার সঙ্গে সরকারের দেওয়া ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার অর্থসহ তিনি মোট ১ লাখ ২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। তিনি আরো বলেন, আগে তার স্বামী ব্যাংকিং চ্যানেলের পাশাপাশি কিছু টাকা হুন্ডির মাধ্যমেও প্রেরণ করতেন। এখন আর তা করেন না। সম্পূর্ণ টাকাই এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরণ করছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত অর্থ উত্তোলনে কোনো সমস্যা হয় কি না তা জানতে চাইলে রুমানা হক জানালেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রেরিত রেমিট্যান্স উত্তোলন এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ করা হয়েছে। ফলে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না বরং অনেক নিরাপদে তিনি টাকা উত্তোলন করতে পারছেন।

শুধু রুমানা হকই নন, তার মতো অনেক নারী রেমিট্যান্সের ওপর সরকারের দেওয়া ২ শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনা পেয়ে খুবই খুশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের ওপর সরকারের পক্ষ থেকে ২ শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের উদ্যোগ বাস্তবায়ন শুরু হয় (২০১৯-২০২০) থেকে। একই সঙ্গে স্থানীয় সুবিধাভোগীদের রেমিট্যান্সের টাকা উত্তোলনে যাতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয় তা নিশ্চিত করা হয়েছে। করোনার মধ্যেও রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রেরণে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এখন প্রবাসীদের উপার্জিত অর্থ পুরোপুরি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। সরকারের এই উদ্যোগ বিস্ময়কর সাফল্য বয়ে এনেছে রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে। এখন প্রবাসী বাংলাদেশিরা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন না বললেই চলে। ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঊর্ধ্বমুখী গতি ধারাবাহিকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে থেকেই অর্থাৎ গত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বব্যাপী সৃষ্ট আর্থিক মন্দার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এক ধরনের মন্দাবস্থার সূচনা হয়। অর্থনীতির বেশিরভাগ সেক্টরই নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল জনশক্তি রপ্তানি খাত। জনশক্তি রপ্তানি খাত তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়।

গত বছর নভেম্বর মাসে চীনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে খুব দ্রুত তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে স্থবির হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে কর্মসংস্থানে যুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকেই ফিরে আসতে বাধ্য হন। অনেকে আবার কর্মচ্যুত হয়ে প্রবাসেই অবস্থান করতে থাকেন। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা জনশক্তি রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জনশক্তি রপ্তানি খাত ব্যাপক অবদান রাখছে। এখনো পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এরপরই জনশক্তি রপ্তানি খাতের অবস্থান। তবে এক অর্থে জনশক্তি রপ্তানি খাতের সম্ভাবনা পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাতের চেয়ে বেশি। কারণ পণ্য ও সেবা রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার মধ্যে ৬০ থেকে ৬৪ শতাংশই শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি বাবদ পুনরায় বিদেশে চলে যায়। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানি খাতের জন্য কোনো কাঁচামাল বা ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি করতে হয় না। ফলে এ খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। এ ছাড়া কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে স্থানীয় বা অভ্যন্তরীণ বেকার সমস্যা সমাধানেও এ খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।

বর্তমানে প্রায় সোয়া কোটি বাংলাদেশি বিদেশে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে এবং মূল্যবান অর্থ নিজ দেশে প্রেরণ করছে। এরা দেশে থাকলে কর্মসংস্থানের অভাব কতটা প্রকট হতে তা সহজেই অনুমেয়। সরকারের সময়োপযোগী নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে এখনো কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকারের সঠিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে অর্থনীতির অধিকাংশ সেক্টরই এখন আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পর্যায়ে রয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশে পরিণত হবে বলে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা মন্তব্য করেছে। প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত পণ্য রপ্তানি ইতোমধ্যে গতিশীল হয়ে উঠেছে। তবে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। প্রবাসী আয় অর্জনের ক্ষেত্রে একের পর এক রেকর্ড সৃষ্টি হয়ে চলেছে। গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করে। ব্যাপকভাবে জনশক্তি রপ্তানি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর গত ৫ বছরে বাংলাদেশ আর কখনোই এক মাসে এত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরণ করতে পারেনি। নভেম্বর, ২০২০ মাসের প্রথম ১২ দিনে বাংলাদেশ ১০৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার সমতুল্য ৯ হাজার ৬১ কোটি টাকা রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। অতীতে আর কখনোই মাত্র ১২ দিনে এত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরিত হয়নি। এ নিয়ে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা মোট ১ হাজার ৪০০ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করেছেন। গত অর্থবছরের একই সময়ে মোট ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছিল। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি করে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন (১ হাজার ৮৩২ কোটি) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স আয় করেছে। এটা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ বেশি। রেমিট্যান্স প্রবাহ এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি খাত। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনার কারণে অনেক বাংলাদেশি কর্মী চাকরিচ্যুত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এদের পুনরায় বিদেশে প্রেরণের নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেহেতু এরা সবাই প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ তাই তারা চেষ্টা করলেই বিদেশে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে পারবেন। এছাড়া আগামীতে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হবে তখন বর্ধিত শ্রম শক্তির প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ সেই চাহিদা পূরণের বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সীমিত সংখ্যক দেশকেন্দ্রিক জনশক্তি রপ্তানি। আগামীতে জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনাময় নতুন নতুন ক্ষেত্রে খুঁজে বের করতে সরকার কাজ করছে। বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে কর্মসংস্থান উপলক্ষে গমন করেন তাদের বেশিরভাগই অদক্ষ এবং অশিক্ষিত শ্রমিক। তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়ানো হচ্ছে। প্রবাসী আয় আরো বাড়ানোর জন্য দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মী রপ্তানির ওপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে প্রেরণের আগে সংশ্লিষ্ট দেশের স্থানীয় ভাষা শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে। সরকার নানাভাবে জনশক্তি রপ্তানি খাতের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যাতে আগামীতে জনশক্তি রপ্তানিই হতে পারে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত। এছাড়া সৌদি আরব সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে নিয়মকানুন কিছুটা শিথিল করেছে। ফলে দেশটিতে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করার প্রয়াসে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো তৎপর রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠান বিদেশগামীদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নারীদের জন্য বিনামূলে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এখান থেকে ছয় মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নারীরা দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান করে নিচ্ছেন। সরকারের লক্ষ্য সাধারণ কর্মীদের পরিবর্তে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত পেশাজীবীদের বিদেশে প্রেরণ করা, যাতে তারা বিদেশে গিয়ে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার না হন। মানসম্মত কাজের বিনিময়ে বেশি রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করতে পারেন। সরকারের এ প্রেচেষ্ট সফল করতে আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে।                               

 

পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম ফিচার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads