• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

করোনাকালে প্রাথমিক শিক্ষা এনজিও ও সরকারের অবস্থান

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

একটি জাতীয় দৈনিকে ‘প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে এনজিওদের উদ্ভট কাজে বিরক্ত সরকার’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার আগেই দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়া শিক্ষামূলক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল বলে জানিয়েছে ইউনেস্কো। করোনার কারণে এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। বাংলাদেশে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষার ওপর প্রভাব নিয়ে আগস্টে প্রকাশিত জাতিসংঘ মহাসচিবের পলিসি ব্রিফের তথ্য দিয়ে ইউনেস্কো এসব তথ্য জানিয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশ্বে শিক্ষা বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি ২ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে বলে ইঙ্গিত করেছেন। প্রাক-প্রাথমিকে এক কোটি ১৮ লাখ ৫ হাজার ৮২৫ জন, প্রাথমিকে ৮৭ লাখ ৯৯ হাজার ৩৩ জন, মাধ্যমিকে ৮৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৪৬ জন এবং উচ্চশিক্ষায় ১২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৫ জন। মহাসচিব বলেছেন, ‘মহামারীর আগেই আমরা একটি শিক্ষা সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম। এখন প্রজন্মের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছি, যা মানুষের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করতে পারে। কয়েক দশকের অগ্রগতিকে বিনষ্ট করে সমাজের বৈষম্যকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে।’ ইউনেস্কোর তথ্যমতে মহামারীর চূড়ান্ত সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় ১৯০টিরও বেশি দেশে প্রায় ১৬০ কোটি শিক্ষার্থীর বা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের ৯৯ শতাংশের ওপর প্রভাব পড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দাতা সংস্থাগুলোও দরিদ্র দেশগুলোর দিকে যতটা পেরেছে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করে, তারাও বিভিন্নভাবে অর্থ-সাহায্য পেয়েছে। শোনা যাচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও একীভূত শিক্ষা এবং করোনাকালে বিদেশ থেকে অনুদান এনে তা সঠিকভাবে কাজে লাগায়নি। ফলে সরকারি তরফ থেকে বিশেষ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হয়েছে।

অনেক এলাকায় বিভিন্ন এনজিও নিজেদের খেয়াল খুশিমত প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন জটিলতা এবং সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ জটিলতায় এনজিওগুলোর কাজে বিরক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিপ্তরের কর্মকর্তারা। সাধারণত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে এনজিওগুলো এক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রের মাঠপর্যায়ের এনজিওগুলোর কার্যক্রম মনিটরিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে অধিদপ্তর। মনিটরিং ও সমন্বয় সাধনের জন্য প্রাথমিক কার্যক্রমে জড়িত এনজিওগুলোর তথ্য চাওয়া হয়েছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এসব এনজিওগুলোর তথ্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আদেশ জারি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা এবং একীভূত শিক্ষাসহ অন্যান্য বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাধারনত এনজিও ব্যুরো, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা কখনো কখনো প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে এনজিও কার্যক্রম সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সঠিকভাবে অবগত নয়। ফলে এনজিও কর্তৃক বাস্তবায়নকৃত কার্যক্রমে বিভিন্ন জটিলতা ও সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন এনজিওর কার্যক্রম যথাযথভাবে মনিটরিং, সমন্বয় সাধন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব এনজিও কাজ করছে, তাদের সঠিক তথ্য প্রয়োজন।

মার্চ থেকে আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম কোনোরকম চালিয়ে নেওয়ার কয়েক ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে এর ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য। ইউনেস্কো এক্ষেত্রে বলছে, স্কুল বন্ধ হওয়া শুধু শিক্ষাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না। সুষম খাদ্যের জোগান, অভিভাবকদের কাজ করতে যেতে না পারা-সহ প্রয়োজনীয় অনেক পরিষেবাকেও বাধাগ্রস্ত করে। এ ছাড়া নারী ও মেয়েদের প্রতি সহিংসার ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে। প্রজন্মের বিপর্যয় থেকে শিক্ষা সংকট রোধে বিশ্বনেতা এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ইউনেস্কোর তরফ থেকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। করোনার কারণে আরো ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সম্প্রতি পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিমেশন বিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া পরিস্থিতির প্রভাবে শহরের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৮২ শতাংশ আর গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে ৭৯ শতাংশ। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল বন্ধ থাকা ও পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ায় স্কুলগামী কিশেরা-কিশোরীরা উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায় ভুগছে। রাজধানী ঢাকার বস্তি এলাকা ও স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে করা একটি গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা আরো জানিয়েছে, স্কুলে শিক্ষকের সহায়তায় পড়াশোনা করা যতটা সহজ, বাসায় বসে পড়াশোনা করা তার চেয়ে বেশ কঠিন। কারণ অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছ থেকে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা স্কুল বন্ধ থাকায় কেউ পাচ্ছে না।

বিভিন্ন শিক্ষাবিদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, করোনার কারণে বিশাল অংশের শিক্ষার্থীরা তাদের পরিবারের সঙ্গে বেঁচে থাকার অন্বেষণে স্থানান্তরিত হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আর স্কুলে ফিরে আসবে না। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ, ২০১৮-তে ১৮.৬ শতাংশ, ২০১৭-তে ১৮.৮৫ শতাংশ, ২০১৬-তে ১৯.২ শতাংশ, ২০১৫-তে ২০.৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২০.৯ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৫.১ শতাংশ। তারপর থেকে পাঁচ বছর নানা উদ্যোগের ফলে ব্যাপকভাবে ঝরে পড়া কমেছে কিন্তু গত ৫ বছর ধরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার একইবৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ, ২০১৭-তে ৩৭.৮১ শতাংশ, ২০১৬-তে ৩৮.৩০ শতাংশ, ২০১৫-তে ৪০.২৯ শতাংশ এবং ২০১৪-তে ৪১.৫৯ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালের মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ৫৫.৩১ শতাংশ। তার পরের পাঁচ বছর দ্রুতগতিতে ঝরে পড়ার হার কমলেও গত পাঁচ বছরে তা ঝিমিয়ে পড়েছে। এ বিষয়টি বেশ উদ্বেগের। উদ্বেগে দেশের জন্য, সরকারের জন্য এবং শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের সবার জন্য। এখানে পরস্পরকে দোষারোপ করা, সমন্বয়হীনভাবে কাজ করা এক্ষেত্রে শুভ ফল বয়ে আনবে না। প্রাথমিক শিক্ষা বিভিন্নভাবে চলছে তবে কোনোটিই আশারূপ ফল নিয়ে আসছে না। এটি আনন্দের বিষয় যে, প্রাথমিক শিক্ষা রাষ্ট্রীয় তরফ থেকে আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে দৃষ্টি  ও গুরুত্ব পাচ্ছে, উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। তবে কাঙ্ক্ষিত মানে যে আমরা পৌঁছাতে পারিনি সেটি সবাইকে স্বীকার করতে হবে। বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ে যে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোতে রয়েছে অন্য ধরনের সমস্যা। প্রাথমিক শিক্ষা শুধু সরকারি হলেও চলবে না আবার শুধু বেসরকারি হলেও চলবে না। এক্ষেত্রে এলাকা ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন, কে কোন এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করবে এবং কে কীভাবে ও কী ধরনের শিক্ষা প্রদান করবে, সেটি জানা থাকা প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সবার। এখানে প্রয়োজন যৌথ প্রচেষ্টার, থাকতে হবে সুস্থ প্রতিযোগিতাও। তা না হলে যেভাবে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা চলছে, সেটি দিয়ে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মতো ভবিষ্যৎ নাগরিক আমরা তৈরি করতে পারব কি না প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

 

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads