• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

শান্তিনিকেতন ও অমর্ত্য সেনের বাড়ি-বিতর্ক

  • প্রকাশিত ২৯ ডিসেম্বর ২০২০

নাজমুল হাসান

 

 

 

‘শান্তিনিকেতন’ বাঙালির এক পীঠস্থান। যারা সেখানে পড়েছেন, বাস করেন, কেবল তাদের কাছেই নয়- বাংলা সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ রয়েছে, এমন সবার কাছেই। বিশ্বভারতী শতবর্ষে পা দিচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে গৌরবের কথা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিছু অগৌরবের কথাও আমাদের কানে পৌঁছাচ্ছে। যেমন— অমর্ত্য সেনের বাড়ি ‘প্রতীচী’ নিয়ে চলমান বিতর্ক। শান্তিনিকেতনে বেশকিছু নামি লোকের বাস রয়েছে, যারা অবসর নিয়ে বাড়ি বানিয়ে আছেন। বা ছুটিছাটা পেলেই শান্তিনিকেতনে গিয়ে জোটেন। অমর্ত্য সেনকে এই পাল্লায় গড় করলে চলে না। তিনি শতাব্দীশ্রেষ্ঠ, প্রাণবান চিন্তক। এই পরিচয় তুলে রাখলেও তার সঙ্গে শান্তিনিকেতনের রয়েছে নাড়ির যোগ। এই সংস্কৃতি-ধাম গড়ে ওঠার পর্বে নানার খড়ের কুটিরে তার জন্ম। দেখতে রবীন্দ্রনাথও ঢুঁ মেরেছিলেন সে কুটিরে। পড়াশোনাটাও শুরু হয়েছিল এখানেই। বাংলা মাধ্যমে। পরে বাঙালির সন্তান ছড়িয়ে পড়েছেন বিশ্বে। এই শান্তিনিকেতনেই ফিরেছিলেন নোবেল জয়ের পর। সেটিও দু’দশক আগের কথা। আজ সেই মানুষটা সন্দেহাতীত উৎকর্ষে পৌঁছেছেন। চলে গেছেন চিরকালের সেরাদের তালিকায়। নানা ক্ষিতিমোহন সেন আজীবন এখানেই কাটিয়েছেন। বিশ্রুত পণ্ডিত। বিশ্বভারতীর উপাচার্যও ছিলেন। মা অমিতা সেন ছিলেন গুরুদেবের আশ্রমকন্যা। বাবা আশুতোষ সেন আশি বছর আগে, ১৯৪০ সালে ‘প্রতীচী’ নামের যে বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেই নামটিকেও রীতিমতো বিশ্বের দরবারে অমর্ত্য ছড়িয়ে দিয়েছেন ‘প্রতীচী ট্রাস্টে’র মাধ্যমে। বিশ্বভারতী-প্রশাসন এবার কাণ্ড ঘটালো এই বাড়িটি নিয়েই। যেখানে খেলোয়াড়ের পাট নিয়েছেন ‘বিজেপি’-বশংবদ উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। বলতে দ্বিধা নেই, রাজনীতিটাও যার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে।

দিনকতক আগে শুনেছিলাম, বিশ্বভারতীর উপাচার্য অমর্ত্য সেনের ফোন পেয়েছিলেন। ওপার থেকে পরিচয় এসেছিল— ‘আমি ভারতরত্ন অমর্ত্য সেন বলছি।’ অমর্ত্য সেন এটি অস্বীকার করেছেন। আমাদের মতো অর্বাচীনদেরও এটা বোঝার কথা— অমর্ত্য সেনের মতো মানুষ এভাবে নিজের পরিচয় দেবেন না। নিত্য উঠতে-বসতে যে ‘ভারতরত্ন’ কিনা রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষরা কেড়ে নিতে চান! অথচ উপাচার্যের মাথায় এই বোধটুকু ঢোকেনি। এবার তিনি অভিযোগ তুলেছেন— ‘প্রতীচী’র খানিকটা অংশ গড়া হয়েছে বিশ্বভারতীর জায়গা দখলে নিয়ে। সেটি উদ্ধারই তাঁর ব্রত। এমন অভিযোগে বহু মহলই বেশ হদ্দ হয়েছেন। এমনকি দুঃখ পেয়েছেন স্বয়ং অমর্ত্য সেনও। তাঁর বক্তব্য— বিশ্বভারতীর লিজ দেওয়া জমির সঙ্গে আরো কিছু জমি কিনে বাড়িটি গড়েছিলেন তার বাবা। লিজের মেয়াদ এখনো বহাল রয়েছে। এমনকি এই জমিটি ২০০৬ সালে তাকে হস্তান্তরেরও একটা প্রক্রিয়া ঘটেছিল। তাদের কাছে এর কাগুজে দলিল-দস্তাবেজও রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বভারতী-প্রশাসন এ ব্যাপারে অমর্ত্য সেনকে কিছু না অবহিত করেই অভিযোগ করে চলেছেন ক্রমাগত। যাকে অমর্ত্য সেন অভিহিত করেছেন মিথ্যাচার নামে। অবশ্য তার পেছনে লাগার এই গোমরও আমাদের অজানা নয়। কারণ তিনিই তো ভারতে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে প্রধান কণ্ঠস্বর। যিনি ‘বিজেপি’ সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও ‘বহুত্ব’-চেতনা ধ্বংসের অভিযোগ এনেছেন। এমনকি এর আগেও আমরা অমর্ত্য সেনকে সরকারের হাতে হেনস্তা হতে দেখেছি। একপর্যায়ে তাকে পিছু হটতে হয়েছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে। আশা ও দুরাশার কথা— পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক করে অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন— বোনের মতোই পাশে থাকবেন।

তবে মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্যটা যে রাজনৈতিক। সে বিষয়টিও মোটেও চাপা থাকে না। প্রথমত বিশ্বভারতী কেন্দ্রশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে অমর্ত্য সেনের বাড়ি সম্পর্কিত কোনো দায়ভার তার সরকারের ওপর বর্তায় না। দ্বিতীয়ত গেরুয়া-শিবিরের আঘাতে ‘তৃণমূল কংগ্রেসে’ যে ভাঙনের ঢেউ লেগেছে; সেই প্রতিশোধটাও অমর্ত্য সেনের পাশে দাঁড়িয়ে খানিকটা চড়িয়ে নেওয়া। ‘বিজেপি’ নেতা অমিত শাহ বোলপুরে সদ্য সভা করে গেছেন। ডিসেম্বরের শেষে মমতা ব্যানার্জিও বোলপুরে সভা করতে যাচ্ছেন। তার আগে এই ইস্যুটা একটু ঝালিয়ে নিলেন আর কি! যাতে সেখান থেকে সুর চড়ানো যায়। নইলে মমতা ব্যানার্জিকে মনীষীদের পক্ষে এমন ‘রণংদেহী’ দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তার দল ‘তৃণমূল কংগ্রেসে’র মাফিয়া অনুব্রত মণ্ডল যখন শঙ্খ ঘোষের প্রতি চরম অপমানজনক মন্তব্য করেছিল, তখনো মমতা ব্যানার্জি মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন। এ কারণে অমর্ত্য সেনের পাশে তাঁর দাঁড়ানোটা একদিক থেকে যেমন আশার, তেমনি দুরাশারও বলতে হবে। ২০১১ সালের পরিবর্তনটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য মোটেও সুখকর হয়নি। আবার, ২০২১ সালের হাওয়াটা কোনদিকে গড়ায়— এটা লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সব ব্যাপারকেই এখন রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। মনীষীদের নিয়ে কু-তরজাও যেখানে বাকি থাকছে না। সন্দেহ নেই, অমর্ত্য সেনের বাড়ি বিতর্কও এই পথ ধরেই এসেছে। তবে শঙ্কার কারণ এটাই— ‘প্রতীচী’ তো কোনো সাধারণ বাড়ি নয়। এটি পরিণত হয়েছে শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যেরই একটি অংশে। যেটি নিয়ে বাঙালি আজো গর্ব করে, আগামীতেও করবে। সুতরাং অপরাজনীতির কোপ থেকে ‘প্রতীচী’ রক্ষা পাবে, এমন দাবি রাখাটা অযৌক্তিক মনে করি না।

 

লেখক : গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads