• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ব্রাত্যজনের কথা

  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২১

আহমদ মোস্তাক

 

 

 

সভ্যতার সূচনা মূলত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ আবহের মধ্য দিয়ে। রাষ্ট্রসৃষ্টির ক্ষুদ্রতম একক যদি হয় বহুপ্রাচীন অথচ  শক্তিশালী গ্রামীণ পরিবারপ্রথা, তাহলে উন্নত ও আত্মনির্ভরশীল একটি রাষ্ট্রের জন্য বর্তমান সময়ে প্রয়োজন মর্যাদাপূর্ণ ও শক্তিশালী গ্রামীণসমাজ। গুহাবাসী পূর্বপুরুষেরা তাদের শক্তিশালী সংঘবদ্ধশক্তি ও দৃঢ় মনোবল দিয়ে প্রাকৃতিক সংকুলতা কাটিয়ে বর্তমান সত্যতাকে এই পর্যায়ে তুলে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু এই সভ্যতার পশ্চাৎপদ ব্রাত্যসমাজকে কী দিয়েছে বা দিচ্ছে, বর্তমানে সেটাই বাংলাদেশের পঞ্চাশতম বর্ষে  আলোচ্য ও উল্লেখ্য একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের গ্রামীণ পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী যথাযথ শিক্ষা ও প্রযুক্তির অভাবে এখন পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে পিছিয়েপড়া বঞ্চিতদের কাতারে অবস্থান করছে। মৌলিক অধিকার নিশ্চয়তার অভাব ও নগরকেন্দ্রিক রাজনীতি এবং নীতিনির্ধারণ এই ব্রাত্যসমাজকে তেমন কিছুই দেয়নি। এতে করে সবচেয়ে রাষ্ট্রই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি বৃক্ষের একপাশের শাখাছেদন এবং অন্যপাশে জলসেচন করলে সেখানে কখনোই যথাযথ ফল লাভ করা যায় না। তেমনি গ্রামীণ ব্রাত্যসমাজকে অবহেলিত রেখে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব।

বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নকে গ্রামীণ পিছিয়েপড়া অঞ্চলের কিছু চিত্র দেখা যাচ্ছে। ফসল উৎপাদনে কিছু প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও প্রয়োগ, অধিক ফলনশীল শস্যচাষ কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করেছে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাকাসড়ক নির্মাণ, প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে পদক্ষেপ গ্রহণ, সেচকাজে বিদ্যুৎ প্রদান অত্যন্ত সাধুবাদপ্রাপ্তির মতো কাজ। কিন্তু সমস্যা হলো, সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেগুলো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথভাবে না হওয়া।

অবকাঠামো নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অসততার ফলে বছর না যেতেই কোটি টাকা বাজেটের পাকা সড়ক ভেঙে পড়ছে। ফলে কৃষিপণ্যের পরিবহন ও বাজারজাতকরণের অসুবিধায় কৃষক আগের মতোই বঞ্চিত হচ্ছে। সেতু-কালভার্টের করুণ অবস্থা চলছে। বহুতল ভবনে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার গালে চপেটাঘাত করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে উন্নয়নের সঠিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়ন। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানের পহেলা বৈশাখের চেয়ে পহেলা জানুয়ারি এবং চৈত্রসংক্রান্তির চেয়ে থার্টি-ফার্স্টের প্রচলন আমাদের দেশে জমকালো হয়ে উঠেছে। এমন অনেক বৈসংস্কৃতি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আমাদের ওপর শুধু মূলধারার ব্রাত্যসংস্কৃতিকে প্রাধান্য না দেওয়ায়। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দিন দিন গ্রাম্যজীবনেও পড়তে শুরু করেছে যা নগরসমাজ হারিয়েছে বহু আগেই। সামাজিক অনুশাসন, প্রথাপার্বণ, রীতিনীতির তোয়াক্কা থোড়াই কেয়ার করছে মানুষজন। ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয় স্রোতের অনুকূলে নৌকা ভাসাচ্ছে দিন দিন।

বর্তমান সময়ে গ্রামীণ রাজনীতি কিছু সুবিধাভোগী পেটুক শ্রেণির দখলে চলে গেছে। ত্যাগী ও আদর্শবান নেতারা এসব সুবিধাভোগী শ্রেণি দ্বারা অপমানিত হয়ে জনকল্যাণবিমুখী হয়ে পড়ছেন। ফলে খেটেখাওয়া নিপীড়িতজন সঠিক প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। করোনাকালে এই অবস্থা আমার স্বচক্ষে দেখেছি। এমনিতেই নগর থেকে পরিচালিত সরকার নগরের উন্নয়নে মশগুল তাতে আবার গ্রামীণ রাজনীতি পেটুক সুবিধাভোগীদের দখলে। এতে করে নিম্নবর্গের মানুষজনের ঘরে শুধু হাহাকার আর কান্না। সময় এসেছে এখন গ্রামীণ ব্রাত্যসমাজকে সঠিক মূল্যায়ন করে সামগ্রিক উন্নয়ন সাধন করার। কৃষিপণ্যের ফলন বৃদ্ধি, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং সাংস্কৃতিক বিনির্মাণ গ্রামীণ অবহেলিত মানুষের মূল্যায়ন দেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। এজন্য যুবসম্প্রদায়কে দক্ষ করে তুলতে সরকারের অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে হবে। নৈতিক ও রাজনৈতিক জ্ঞান, মূল্যবোধ এবং সামাজিক অনুশাসন ত্বরান্বিত করতেও ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি পিছিয়েপড়া এই জনসমাজকে জনশক্তিতে পরিণত করলে দেশকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।

বর্তমান সময়ে নীতিনির্ধারকদের উচিত ব্রাত্যজনকে প্রাধ্যান্য দিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। শুধু বাস্তবায়ন করেই নিশ্চিত হলে চলবে না বরং রক্ষণাবেক্ষণেরর দিকেও মন দিতে হবে। ব্রাত্যজনের দিকে যথাযথ দৃষ্টি দিলে তবেই দেশের এই পঞ্চাশতম বর্ষে আমারদের সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন সার্থকতার পথ দেখতে পাবে।

 

লেখক : তরুণ উদ্যোক্তা, সাবেক ছাত্র, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads