• সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিজ্ঞানচর্চায় বাংলাদেশের অগ্রগতি

  • প্রকাশিত ৩০ জানুয়ারি ২০২১

বিধান চন্দ্র দাস

 

 

আর কয়েকটি দিন পরেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চলেছি। বিগত পাঁচ দশকে আর্থ-সামাজিক অনেকগুলো সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য দেখিয়েছে।’ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের আত্মশ্লাঘার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে আমরা মনে করি।

আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বিষয় নিয়ে যত আলোচনা হয়, সেই তুলনায় বিজ্ঞান নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ উন্নয়নশীল দেশে আর্থ-সামাজিক বিষয়টির আলোচনা অগ্রাধিকার পায়। তবে বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারেও সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ব্যক্তি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে দেশে বিগত পাঁচ দশকে, বিজ্ঞানচর্চা বিষয়টি পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভায় ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা’ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন ড. মফিজ চৌধুরী। অবশ্য তার অধীনে আরো তিনটি পোর্টফোলিও (বিদ্যুৎ, প্রাকৃতিক সম্পদ ও আণবিক শক্তি) ছিল। ড. মফিজ চৌধুরী গত শতকের চল্লিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেমিস্ট্রি ও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিলেন। সদ্য স্বাধীন একটি দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্বের কথা চিন্তা করেই বঙ্গবন্ধু ড. মফিজ চৌধুরীকে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট এতগুলো পোর্টফোলিও দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পর নানা ধরনের সীমাবদ্ধতার মাঝেও বিজ্ঞান গবেষণায় নতুন প্রাণসঞ্চার হয়েছিল। বিশেষ করে দেশের প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, আণবিক শক্তিকেন্দ্র ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণায় প্রাণ ফিরে এসেছিল। ১৯৭৩ সালে দেশে শিশু খাদ্য সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন তরুণ বিজ্ঞানী নতুন একটি শিশুখাদ্য আবিষ্কার করেন। সে সময়ের বাস্তবতায় এই আবিষ্কার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি নিয়ে সেই সময় দৈনিক বাংলায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছিল। সংখ্যায় কম হলেও তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়েছিল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দেশে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার/উদ্ভাবন পেটেন্ট হয়েছিল ৫০টি (বিদেশসহ মোট ৩৬৪টি)।

প্রকৃতপক্ষে, স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রায় সব ক্ষেত্রে এক ধরনের জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দেশে অসংখ্য বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্রিক জাতীয় সমিতি জন্ম নিয়েছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : বাংলাদেশ ভৌতবিজ্ঞান সমিতি, বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি, বাংলাদেশ গণিত সমিতি, বাংলাদেশ উদ্ভিদবিজ্ঞান সমিতি, বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতি, বাংলাদেশ ভূগোল সমিতি, বাংলাদেশ ভূতত্ত্ব সমিতি ইত্যাদি। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স এই সময়েই পুনর্গঠিত হয়। দেশে কৃষি গবেষণা সমন্বয়, পরিকল্পনা, গবেষণার বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের জন্য ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের সমিতি বা সংস্থাগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পর দেশে বিজ্ঞানচর্চা অনেক প্রসারিত হয়েছে। সরকারি বেসরকারি সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা দেড়শ ছাড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে অসংখ্য শিক্ষার্থী এখন পড়াশোনা করছে। অনেক কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস করানো হচ্ছে। দেশ কিংবা বিদেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বহু শিক্ষক এখন কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তাদের অনেকে গবেষণায়ও জড়িত আছেন।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। স্বাধীনতার পর বিগত পাঁচ দশকে কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে নতুন জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১০৫টি উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া সার, সেচ, পানি ও ফসল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত নানা পদ্ধতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেছে। ব্যক্তি পর্যায়ে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসাদনগর গ্রামের একজন কৃষক ১৯৯৬ সালে একটি বিশেষ জাতের ধান (হরি ধান) উদ্ভাবন করেছিলেন।

কৃষি বিষয়ক অন্যান্য কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশকিছু নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ধরনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উদ্ভাবিত নতুন জাত সংখ্যা : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-৫৪৫, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট-৪৯, বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট-২৮, বাংলাদেশ তুলা উন্নয়ন বোর্ড-১৯, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট-২৬, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট-তুঁত৮১ এবং রেশমকীট-১১১। এছাড়া এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানা ধরনের প্রযুক্তিও উদ্ভাবন করা হয়েছে।

ধান ও অন্যান্য ফসলের নতুন এই জাতগুলোর মধ্যে কিছু জাত প্রতিকূল পরিবেশ, যেমন- লবণাক্ততা, বন্যা, খরা ও ঠান্ডার মধ্যেও চাষ করা সম্ভব। কাজেই এই জাতগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অবস্থা মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছের প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ পদ্ধতি এবং মৎস্যসম্পদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রায় ৪৬টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সংখ্যা ৮৭ (প্রাণী উৎপাদন বিষয়ক ২০, পোলট্রি উৎপাদন বিষয়ক ১৪, প্রাণীস্বাস্থ্য বিষয়ক ২৫, খাদ্য ও পুষ্টি ব্যবস্থাপনা ২৮)।

জিনোম সিকোয়েন্সিং (জীবের দেহে থাকা জিনগত সংকেতগুলোকে একের পর এক বিন্যস্ত করা/অনুসন্ধান করা) গবেষণাতেও বাংলাদেশ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট দেশি পাট ও তোষা পাটসহ একটি ক্ষতিকারক ছত্রাকের জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচন করেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ইলিশ মাছের জিন নকশা বের করেছেন। দেশে করোনা ভাইরাসের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন)। এরপর বাংলাদেশে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করে।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলো বিশেষ করে বিসিএসআইআর (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন তাদের আবিষ্কার/উদ্ভাবনে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। বিসিএসআইআরের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার/উদ্ভাবন হচ্ছে : উন্নত চুলা, স্পিরুলিনা ও ক্লোরেলা শৈবাল উৎপাদন, আগ্নেয়াস্ত্র গুলির আর্দ্রতা নিরোধক, অগ্নিনির্বাপক রাসায়নিক, লেমনগ্রাস তেল, ডায়াবেটিক মিষ্টি, ওয়াটার ফিল্টার, সৌর ড্রয়ার, বিভিন্ন সুগন্ধি দ্রব্য, বর্জ্য থেকে গ্লিসারিন তৈরি, সয়া দুধ, মাল্টিপারপাস ফুড ইত্যাদি। বিগত দশ বছরে এই সংস্থা ৪৮টি পেটেন্ট অর্জন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন কর্তৃক আবিষ্কার/উদ্ভাবন হচ্ছে : ১৭টি ভারী খনিজ বালি স্তূপ এবং এগুলোর বিস্তৃতি, মজুত ও গুণগত মান নির্ণয়; টেকনিশিয়াম-৯৯ জেনারেটরের স্থানীয় অটোমেশন পদ্ধতি; মোলাসেস থেকে অধিক মাত্রায় সাইট্রিক অ্যাসিড উৎপাদন; ৪টি ফসলের জাত, নতুন প্রজাতির মাছি (অন্য প্রতিষ্ঠানও নতুন কিছু প্রজাতি আবিষ্কার করেছে) ইত্যাদি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিদেশি অতিপ্রয়োজনীয় কিছু ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির বিকল্প স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্লাস্টিক বোতল ভেন্টিলেটর। নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষেত্রে সাহায্য করে এই প্লাস্টিক বোতল ভেন্টিলেটর। এছাড়া প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ কমানোর জন্য ‘হাইড্রোস্ট্যাটিক কনডম ক্যাথেটার’ পদ্ধতি বাংলাদেশে উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এখন দেশের ৯৭ শতাংশ চাহিদা মিটিয়ে প্রায় দেড়শ দেশে রপ্তানি করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশিদের দ্বারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বেশকিছু আবিষ্কার/উদ্ভাবন সম্পন্ন হয়েছে। তবে এগুলো বাংলাদেশের আবিষ্কার/উদ্ভাবন বলে দাবি করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, এসব আবিষ্কার/উদ্ভাবন বিদেশের সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে।

বর্তমানে কোনো একটি দেশের বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে সেই দেশ থেকে স্বীকৃত জার্নালে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশনা। প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ, অন্যান্যরা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করলে সেই প্রবন্ধটির মান বেড়ে যায়। এর ওপর ভিত্তি করে বর্তমানে বিভিন্ন দেশের গবেষক, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দেশের গবেষণা মান নির্ধারণ করা হয়। কয়েকটি সংস্থা এই কাজ করে থাকে। তারা নিয়মিতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির গবেষণা সংক্রান্ত অর্জন তাদের ওয়েবসাইটে দেয়।

বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলাদেশের মানসম্পন্ন গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা আশাপ্রদ। বর্তমানে ‘নেচার’ গ্রুপ থেকে প্রকাশিত জার্নালগুলোকে পৃথিবীর অন্যতম ভালো জার্নাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এই ‘নেচার’ গ্রুপের জার্নালেও প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। অক্টোবর ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত প্রকাশিত এই গ্রুপের জার্নালে মোট ৩৭টি প্রবন্ধে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের নাম আছে।

গবেষণা মান জরিপ বিষয়ক খ্যাতনামা একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘এিসঅ্যামেগো’। স্পেনভিত্তিক এই সংস্থা প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অন্যান্যের দ্বারা সাইটেশন (উল্লেখ) সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দেশের গবেষণা ‘র্যাংকিং’ (মর্যাদাক্রম) করে থাকে। তারা সাধারণত ‘স্কপাস’ (এলসিভিয়ার পাবলিশার্স গ্রুপ) ডাটা ব্যবহার করে। এদের ওয়েবসাইটে ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ২৪০টি দেশের (জাতিসংঘের বাইরের দেশসহ) গবেষণা র্যাংকিং দেখানো হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সম্মিলিতভাবে মোট ৫৬,০৮৮টি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের সংখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ৬০। বাংলাদেশের প্রতিটি গবেষণা প্রবন্ধের গড় সাইটেশন সংখ্যা ১০.২৬। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনার ধারাবাহিকতা মূল্যায়নের জন্য ‘এইচ-ইনডেক্স’ করে থাকে। তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের ‘এইচ-ইনডেক্স’ দেখানো হয়েছে ২০২। এই ‘এইচ-ইনডেক্স’ অনুযায়ী ২৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৮।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চারও অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর কলেজ পর্যায়ে, বিশেষ করে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক রচনা শুরু হয়। পরবর্তীকালে বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতক সম্মান পর্যায়ের অনেক গ্রন্থ বাংলা ভাষায় রচিত হয়েছে। অনেকে বিজ্ঞান গ্রন্থের অনুবাদও করেছেন। বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় অনেক বিজ্ঞান গ্রন্থ লেখা হয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে। এখন ইন্টারনেটে বাংলাদেশের বিজ্ঞান বিষয়ে অসংখ্য ওয়েব পেজ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা প্রসারের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

দেশের বিজ্ঞানসেবী সংস্থাগুলো (প্রধানত ক্লাব) তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিজ্ঞান কর্মকাণ্ড নির্বাহ করছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের অনেক সংস্থা অর্থ সহায়তা পায়। বহু তরুণ শিক্ষার্থী এগুলোতে যুক্ত থাকে। এসব সংস্থা তাদের সদস্যদের তৈরি করা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি/প্রকল্প নিয়ে বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও এ ধরনের কোনো কোনো সংস্থার কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে। দেশে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী তৈরির জন্য এই সংস্থাগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার বিজ্ঞান প্রচারে সাহায্য করছে।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা এগিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ আবিষ্কৃত/উদ্ভাবিত ও গৃহীত পেটেন্ট সংখ্যা ৭০৬ (বিদেশসহ মোট সংখ্যা ৫,৮৮১)। মূলত দেশের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে আমাদের স্বীকার করতেই হবে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা, আবিষ্কার কিংবা উদ্ভাবন সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে কম হচ্ছে। এর জন্য অনেক কিছুকে দায়ী করা হলেও গবেষকদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার বিষয় দুটি সামনে চলে আসে। এ দুটি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

অনেক বিষয়ের প্রাথমিক গবেষণাতেও আমরা পিছিয়ে আছি। যেমন বাংলাদেশে মোট প্রাণী প্রজাতির নব্বই শতাংশ প্রজাতিকে আমরা চিনি না, জানি না। এদের ওপর ভালোভাবে গবেষণা করলে অনেক নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত গবেষণায় প্রজাতি চেনা ও জানা খুবই জরুরি। বিষয়ভিত্তিক প্রাথমিক গবেষণা সম্পন্ন করার জন্য পরিকল্পনা প্রয়োজন। অত্যাধুনিক গবেষণার পাশাপাশি প্রাথমিক গবেষণাগুলোও এগিয়ে নেওয়া দরকার। অনুবাদ কর্মকাণ্ডও প্রসারিত করা প্রয়োজন। সহজ বাংলা ভাষায় রচিত আরো বিজ্ঞান পাঠ্যগ্রন্থ আবশ্যক। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। প্রতিটি বিভাগীয় শহরে বিজ্ঞান জাদুঘর ও ন্যাচারাল হিস্ট্রি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads