• সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

কালোটাকা সাদা করার সংস্কৃতি

  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০২১

মো. জিল্লুর রহমান

 

বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীরা বরাবরই বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রহিত করার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের মতে, এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। তবে সরকার প্রতিবারই বলছে, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যই তারা এমন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। অর্থ যাতে বিদেশে পাচার হতে না পারে এবং দেশের অর্থ দেশেই বিনিয়োগ হয়, এ বিবেচনায় তারা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ দিচ্ছেন। আসলে এ ধরনের সুযোগ দিয়ে দুর্নীতির বিস্তারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে বলে মনে করছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সরকার একদিকে সুশাসনের কথা বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা বার বার উচ্চারণ করছে, আবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছে। প্রকারান্তরে এটা সরকারের দ্বিমুখী নীতির নামান্তর ছাড়া আর কিছুই নয়।

কালোটাকা প্রতিনিয়ত আমাদের অর্থনীতিতে ঢুকছে। কিন্তু এতে দুই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। প্রথমত সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যারা সৎ বিনিয়োগকারী, তারা কালোটাকার সঙ্গে পেরে ওঠেন না। ফলে অর্থনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক অবৈধ আয়ের যে কালো টাকা, তার উৎস হিসেবে মাদক ব্যবসা, অবৈধ ব্যবসা, ঘুষ ও দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছে। আয়কর আইনে কালোটাকা হলো অপ্রদর্শিত আয়। যে আয়ের কর দেওয়া হয়নি। সেই আয় বৈধ এবং অবৈধ দুটোই হতে পারে। কিন্তু এনবিআর আয়কর নেয়ার সময় আয়ের উৎস জানতে চায় না। এখানে আয় বৈধ না অবৈধ সেটা আলাদা করার সুযোগ নেই। দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। এ পর্যন্ত ১৭ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা এবং এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন রেকর্ড পরিমাণ ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে ২০১২-১৩ সাল থেকেই জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা স্থায়ী নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বারই বলা হয় এটাই শেষ সুযোগ কিন্তু কালো টাকা বিশেষ সুযোগ দিয়ে শেয়ার বাজার বা আবাসন খাতের মতো সুনির্দিষ্ট কিছু জায়গায় এলে সেটি দেশের অর্থনীতিতে সত্যিকারভাবে কতটা ভূমিকা রাখে তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিনিয়োগ চাঙা করতে বিদায়ী অর্থবছর থেকে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে সরকার। সেখানে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগকৃত অর্থের ১০ শতাংশ কর দিলেই এখন প্রশ্ন করবে না এনবিআর। ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই সুযোগ আছে। অবশ্য এখন পর্যন্ত কেউ হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে কালোটাকা বিনিয়োগ করেননি। বিদায়ী অর্থবছরে ফ্ল্যাট কেনায়ও তেমন সাড়া পায়নি সরকার।

বাংলাদেশে কালোটাকার পরিমাণ কত তা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের কোনো গবেষণা নেই। অন্যদিকে ২০১১ সালে বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রনালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ ভাগ, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

তবে দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। খুব বেশি সাড়া না মেলায় ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তখনকার সরকার বলেছিল, ‘নানা কারণে অনেকে এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি বলে আবেদন নিবেদন বিবেচনা করে সরকার তাদের কর-অনারোপিত প্রকৃত আয়ের ঘোষণার জন্য এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত আর একবার সুযোগ দিয়েছেন। আশা করা যায়, করদাতারা তাদের এখনো অপ্রকাশিত আয় ঘোষণার এই শেষ সুযোগ হারাবেন না। কেননা, এরপর কর ফাঁকির মামলাসমূহের ব্যাপারে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ তখন মাত্র ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা হয়েছিল।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর আবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে বলা হয়, এর মধ্যে সুযোগ না নিলে সর্বোচ্চ ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার এই সুযোগ নেয় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। আর এতে বৈধ হয় ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা।

২০০৯ সালে নতুন সরকার গঠন করার পর আওয়ামী লীগ আবারো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়। এমনকি আয়কর অধ্যাদেশে স্থায়ীভাবে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে কালোটাকা সাদা করার আইনি সুযোগ রাখা হয়। এই ধারাটি হচ্ছে ১৯ই। এর ফলে প্রযোজ্য আয়করের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা দিলে যে কেউ অর্থ সাদা করতে পারবেন।

প্রায় সব সরকারই অবাধে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, নানা ধরণের হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব হুমকি কেবল বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে তেমন কেউ উৎসাহ দেখায়নি। তবে দুটো ব্যতিক্রম ঘটনার কথা বলাই যায়। যেমন এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি সরকার গঠন করলে তখনকার অর্থমন্ত্রী ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বিগত বছরগুলোতে কালোটাকা বৈধ করার যে ধরণের বৈষম্যমূলক কর দায়মুক্তির সুবিধা দেওয়া হয়েছে, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে এ ধরনের গণতান্ত্রিক ও গোষ্ঠীস্বার্থপ্রসূত বৈষম্যমূলক করনীতি আমাদের এই গণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণ পরিহার করবে।’ পরের পাঁচ অর্থবছরে কালোটাকা সাদা করার আর সুযোগই দেওয়া হয়নি।

দ্বিতীয় ব্যতিক্রম ঘটনাটি ২০০৯ সালের। সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। তখনকার অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব পেয়ে বাজেটের আগে ঘোষণা দিলেন আর কালোটাকা সাদার সুযোগ দেওয়া হবে না। কিন্তু বাজেট ঘোষণায় ঠিকই এ সুযোগ দেওয়া হলে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন তিনি। ফলে এর ব্যাখ্যা দিতে হয়েছিল তাকে। বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। তারপরও এই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ সমঝোতা। কেননা রাজনীতি হলো আপসের সবচেয়ে নিপুণ কৌশল। রাজনীতিতে সব ধরণের মানুষ ও সব ধরনের স্বার্থকে সমন্বয় করে চলতে হয়। এ হচ্ছে রাজনীতির কাছে নৈতিকতার পরাজয়।

দেশে যে পরিমাণ কালোটাকার মালিক আছেন বলে অনুমান করা হয়, সে তুলনায় কালো টাকা সাদা করার চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। ভবিষ্যতে তথ্য গোপনীয় থাকবে না এমন আশঙ্কা থেকেও অনেকে সাদা করতে চান না। আর রাঘব  বোয়ালরা বিদেশে পাচার করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে অভিযোগ আছে। উচিত হবে চাঁদাবাজি, ঘুষের মতো কালোটাকার উৎসমুখ চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া।

অবৈধ কাজকে বৈধ করার আইনগত সুযোগ দেওয়ার এই বিষয়টি কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অনৈতিক একটা বিষয়কে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হলে সৎ করদাতাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয় এবং এটা সামগ্রিকভাবে দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করে। প্রকারান্তরে এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে। কালো টাকা সাদা করার এ সুযোগটি চিরতরে বন্ধ করাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলের প্রধান নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে বলে সংশ্লিষ্টদের দৃঢ় বিশ্বাস।

 

ব্যাংকার ও কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads