• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাংলাদেশের স্বাধীনতার দ্রষ্টা-দার্শনিক

  • প্রকাশিত ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রেজাউল করিম খোকন

 

পাকিস্তান যে বাঙালি জাতির বিকাশে অনুকূল স্থান হবে না, তা তিনি দেশটির জন্মের পর পরই উপলব্ধি করেছিলেন। তার আত্মজীবনীতে এই গভীর উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে। রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তার মৃত্যুর পরে কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মনে একই সাথে হতাশা ও স্বপ্ন তৈরি করেছিল। তিনি বরাবরই আত্মপ্রত্যয়ী এবং কখনো হাল ছাড়ার পাত্র নন। দুটি বিষয় বঙ্গবন্ধু তখনই উপলব্ধি করেছিলেন—পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় এবং মুসলিম লীগ বাঙালির ভবিষ্যৎ নির্মাণের উপযুক্ত রাজনৈতিক দল নয়। ফলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সামনে রেখে ১৯৪৯ সালেই জোতদার উমেদারদের প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী দলটি থেকে বেরিয়ে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি জনগণের মুসলিম লীগ বা আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। তরুণ শেখ মুজিব দলের সামনের কাতারে বর্ষীয়মান নেতাদের রাখলেও এর চালিকা শক্তি যে তিনিই ছিলেন, তা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।

বায়ান্নর ঘটনাবলির পরে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রদেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ক্রমে মুসলিম জাতীয়তাকে ডিঙিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তার চেতনা জোরদার হয়েছে। এই প্রবণতার সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে—মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। তখন থেকেই এই প্রদেশে ধর্মভিত্তিকের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের একচ্ছত্র বিকাশ নিশ্চিত হয়েছে। মুজিব ও তার অনুসারীরা তখনই দল থেকে সাম্প্রদায়িক পরিচয় মুছে দিলেন। আওয়ামী লীগ তখন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হয়েছে।

১৯৬০-এর দশকে সারা পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও সমাজতন্ত্রের ঢেউ এসে লেগেছিল। তখন এ দেশের ছাত্র-তরুণ, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে বামপন্থার দিকে ঝোঁক বেড়েছিল। কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মধ্যে তখন এই ধারার প্রভাব বেড়েছে। শোষণ-বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সব ধরনের সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে এই ধারাতে যে রাজনীতি, তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে যুক্ত করতে সক্ষম হন। তার ঘোষিত ছয় দফায় পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে থেকেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরা হলেও তাতে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখাও অনুক্ত থাকেনি। ততদিনে ছাত্র, তরুণ, শিল্পী বুদ্ধিজীবী কৃষক শ্রমিক সাধারণ মানুষ, সেনা সদস্য, আমলা সমাজের নানাস্তরে বাঙালির স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্দীপনা দেখা গেছে। ছাত্র-তরুণদের স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস কিংবা আগরতলা ষড়যন্ত্র তারই বহিঃপ্রকাশ। বঙ্গবন্ধু এই দুটি এবং এ ধরনের সব উদ্যোগের বিষয়ে জানতেন। এগুলোর সঙ্গে নিজেকে মুক্ত রেখেছেন। এ ধরনের বিপ্লবী চিন্তা ও কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেও তিনি নিজে বিপ্লবের রাজনীতি বা বিপ্লবী সংগঠন নিয়ে মাথা ঘামাননি। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পরে তিনি বঙ্গবন্ধু, জনগণের আস্থাভাজন প্রিয় নেতা এবং সবাইকে ছাপিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, এই জনপদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক। এই সময়ে তার নেতৃত্বের পেছনে দেশের মানুষ কাতারবন্দি হতে থাকে। তিনি মাঠপর্যায়ের তখনকার সময়ের শক্তিশালী প্রগতিশীল বামধারার রাজনৈতিক দল এবং পেশাজীবী, ছাত্র-তরুণ ও শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশের আস্থা অর্জনে সক্ষম হন। সব দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলনে তার ছয় দফার পরিপূরক হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে গতি ও তীক্ষতা দিয়েছিল। এই ঐক্য ও সংগ্রামী চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে।

একাত্তরের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক কর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ও বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করে সংঘাতের পথ রচনায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে এই নির্বাচনের ফলাফলেও পাকিস্তানের দুই প্রদেশের ঐক্য যে অবাস্তব এবং দেশটির ঐক্যবদ্ধ ভবিষ্য যে সংকটাপন্ন, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও ২৬৭টি অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে সব কটি আসনেই জিতেছে। আবার ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোনো ভিত্তিই ছিল না দেশের পূর্বাংশে। দুই প্রদেশে প্রতিনিধিত্বকারী কনভেনশন মুসলিম লীগ আরো আগেই কাগুজে দলে পরিণত হয়েছিল এবং এই বাংলায় চিরকালের জন্য দলটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ মুজিবের চিন্তার দূরদর্শিতার উজ্জ্বল প্রকাশ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু কালের যাত্রাপথে নানা সংকটে-বিপদে-বিপর্যয়ে অবিচল থেকে একে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। নিজেকে সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছেন। পাকিস্তানি শাসক শোষকদের জেলজুলুম নির্যাতন সহ্য করেছেন। নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছেন বার বার। এতসব কিছুর বিনিময়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নকে লালন করে শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ দিতে অবিচল, অটল অনড় থেকেছেন। আপন নীতি, আদর্শ ও দর্শন থেকে বিচ্যুত হননি। পাকিস্তানি শাসকদের লোভ, লালসা, হুমকি, চোখ রাঙানি কিছুই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের পথ থেকে টলাতে পারেনি। এতসব বিবেচনায় খুব সহজেই বলা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রূপকার, স্বাধীন বাংলাদেশের জনক।

ছয় দফা, মাঠের রাজনীতি এবং তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর যাত্রাপথ স্পষ্টই রেখেছিলেন। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এতটাই ভয় পেয়েছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে নিতে কিংবা ভাবতেই চায়নি। এটাও ঠিক যে তারা বাঙালি মুসলমানদের কখনো তাদের সমকক্ষ নাগরিক ভাবতে পারেনি। বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিষয়ে তাদের চরম অনীহা বার বার প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে ব্যর্থতার দায় চাপানোর চক্রান্তের পুরনো কৌশল প্রয়োগের সাহসও করেনি। তাদের মাথায় চেপে বসেছিল সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। এর বিকল্প অন্য কিছু ভাবতে পারেনি পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা।

বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি নেতারা স্বাধীনতার বিষয়ে আপসহীন অবস্থানে অটল থাকলেও এবং তাদের পেছনে জাগ্রত জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ালেও তারা নিশ্চয়ই সত্যিকার যুদ্ধ বেধে যাওয়ার কথা ভাবেননি। তবে আগরতলা ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অবহিত ছিলেন এবং তাতে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি ছিল। তার সত্ত্বেও বলা যায়, বাঙালি রাজনীতিবিদ ও জনগণ বাস্তবের সামরিক অভিযান বা যুদ্ধের রূপ ও তার সঙ্গে যুক্ত জনদুর্ভোগের ব্যাপ্তি, গভীরতা ও মাত্রা সম্পর্কে এতটা সচেতন ছিল না। বঙ্গবন্ধু কাপুুরুষের মতো আত্মগোপন কিংবা গা ঢাকা দিয়ে প্রতিবেশি বন্ধুরাষ্ট্রে গিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালানোর চেয়ে প্রতিপক্ষ পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়াকেই নিজের ভাগ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার বীরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বাংলাদেশের ইতিহাসকে মহিমামণ্ডিত করেছে। বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক অবস্থানে। যেখানে তার সমান্তরালে আর কাউকে ভাবতে পারেনি এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। তবে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদসহ সতীর্থ সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার এবং তার অনুগামী সাধারণ জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। অপ্রস্তুত বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীই বস্তুত ভয়ংকর এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু তারপর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব রূপকথার মতো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। নিষ্ঠুর আক্রমণের মুখে লাখো লাখো নিরস্ত্র মানুষ যেমন তাদের ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ, আপন ভিটে সর্বোপরি নিজের দেশ, প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়েছিল, তেমনি আবার বাঙালি সেনা, পুলিশ, ইপিআর সদস্য এবং কিশোর থেকে বৃদ্ধ—নানা বয়সের হাজার হাজার মানুষ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়েছে। বাংলার ইতিহাসে এ এক অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আহ্বানের মাধ্যমে। যে বাঙালি আড্ডাবাজ, অলস প্রকৃতির, ঘুরকুনো, কলহপ্রবণ এবং ভিতু স্বভাবের বলে পরিচিত ও সমালোচিত হয়ে আসছিল যুগের পর যুগ ধরে তারাই হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী। এ দেশের বীর সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশপ্রেমের অদ্ভুত আবেশ বুকে নিয়ে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক প্রত্যেকের বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দৃপ্ত শপথ নিয়ে মরণশীল লড়াইয়ে নেমেছিল বাংলার কৃষক শ্রমিক-ছাত্র-জনতা। বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে সন্মুখ সমরে, গেরিলা আক্রমণে দুঃসাহসের অসাধারণ প্রমাণ দিয়ে বার বার প্রমাণ করেছে তারা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দেশকে স্বাধীন করতে বেপরোয়া, অপ্রতিরোধ্য। তারা নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত, কোনোভাবেই পিছিয়ে যাওয়ার মতো কাপুরুষ নয়। এভাবেই নয় মাসের সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে পাকিস্তানি চৌকস অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য বাহিনীকে পরাস্ত করে বাঙালি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে, বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সবকিছুর পেছনে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাক মন্ত্রের মতো কাজ করেছে। তাকে বন্দি করে পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখার মাধ্যমে বাঙালিদের মনোবল, সাহস, স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিতে চাইলেও তারা সফল হয়নি। মুক্ত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিদের কাছে।

পাকিস্তানিদের স্বৈরাচারী দমনমূলক আচরণ, শাসন, ঘোষণ-সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার একগুঁয়ে মনোভাব, অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা, ধর্মের দোহাই দিয়ে এক ছাতার নিচে রাখার অপচেষ্টা, মিথ্যে ও শঠতার আশ্রয় নিয়ে ক্রমাগত প্রতারণা ইত্যাদি বাঙালিদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিকাশকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এটি গভীরভাবে উপলব্লি করেছিলেন। তিনি শুধুমাত্র স্বপ্ন দেখে তা মনের মধ্যে রেখে দেননি। বাঙালির যথার্থ বিকাশের পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন স্বপ্ন দেখেই বসে থাকেননি বঙ্গবন্ধু, তিনি স্বাধীন একটি দেশের যাবতীয় সম্ভাবনাও খুঁজে দেখেছেন। আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে জীবনভর বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই রাজনীতি, যিনি বাঙালিদের জন্য পৃথক স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য স্বৈরাচারী জুলুমবাজ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের প্রতিটি ধাপেই বাঙালির সার্বিক মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। তিনি সব সময় বলতেন, এমনকি দু’দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব—আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বাঙালিদের মুক্তির চিন্তাকে তিনি সব সময় হূদয়ে লালন করে গেছেন। জেল জুলুম, নির্যাতন, মৃত্যুর হুমকি—কোনো কিছুতেই দমে যাননি। হূদয় থেকে লালিত স্বপ্ন ও চিন্তাকে মুছে ফেলতে পারেননি। যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, যে বাংলার কোটি কোটি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি যৌবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন, ফাঁসির মঞ্চে গেয়েছেন বাঙালির জয়গান, সেই বাংলা ও বাঙালির জন্য তার হূদয়ের ভালোবাসা অপরিসীম। সমুদ্র না মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব, কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য তার হূদয়ের যে দরদ, যে ভালোবাসা, তার গভীরতা অপরিমেয়।

রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধু বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিলেন আজীবন। তিনি বার বার সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন, এই পৃথিবী পোষক ও শোষিত, দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত এবং তিনি শোষিতের পক্ষে থাকবেন সব সময়। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শোষণ-বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চেয়েছিলেন বলেই রাষ্ট্রের মূল নীতিতে সমাজতন্ত্র যুক্ত করেছিলেন।

জীবনভর ষড়যন্ত্রের ঘেরাটোপে থেকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছিলেন জাতির পিতা, পরিণত হয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা আর শোষণ-বঞ্চনা থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি দাতা। তার অনুভবে ছিল বাংলার স্বাধীনতা, ছিল রাজশোষকদের কবল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি। তিনি চেয়েছিলেন সবার বাক্স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক শোষণমুক্তি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বাঙালির ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা, সার্বিকভাবে সব নাগরিকের কল্যাণময় জীবন। পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতন, ষড়যন্ত্র, মামলা-হামলা কোনো কিছুই বঙ্গবন্ধুকে একচুলও নড়াতে পারেনি তার অবস্থান থেকে। বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী সুবিশাল হূদয়ের এ মানুষটিকে নানাভাবে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তিনি এমনই একজন মহামানব যিনি ১৯৪৮ সাল থেকে সারাটি জীবন বাঙালির মুক্তিভাবনা বুকে নিয়ে অবর্ণনীয় জেলজুলুম-কষ্ট-যাতনা-নির্যাতন সহ্য করেছেন আর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সালে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ের মধে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য অনেক অভাবনীয় পদক্ষেপ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।

 

লেখক : সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads