• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মনের গহিনে আঁকা যুদ্ধস্মৃতি-এক

  • প্রকাশিত ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সোহরাব আলী সরকার

 

আজ অনেকেরই মনে হতে পারে যে হয়তো খুব সহজেই সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু এ ধারণা ঠিক না। নানা পথঘাট পেরিয়ে, অনেক শ্রম-ঘাম-মেধা খরচ করে, বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথ ধরে, উত্তেজনা-আতঙ্ক-নিঃসঙ্গতা, আবার একতা গড়ে তবেই মুক্তিযুদ্ধের নৌকা সচল করতে হয়েছে-এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি নিজে। এতসব ঘটনার সাক্ষী হতে পেরে আমি গর্বিত।

আমি সোহরাব আলী সরকার, জন্ম ১৯৪৫ সালের ২ নভেম্বর। আমার বাবা রজব আলী সরকার ছিলেন কৃষক, মা সালেহা খাতুন গৃহিণী। সিরাজগঞ্জ সদরের কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিকের ধাপ পেরিয়ে ভর্তি হই সিরাজগঞ্জ শহরের ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সিরাজগঞ্জের অনেক ছাত্রনেতার স্কুলজীবনই কেটেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এদের মধ্যে আমির হোসেন ভুলু, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, ইসমাইল হোসেন, আব্দুল বারী শেখ, ইসমাইল হোসেন, ইসহাক আলী, গোলাম কিবরিয়া, এম এ রউফ পাতা অন্যতম। এদের প্রত্যেকেই সিরাজগঞ্জ ছাত্র আন্দোলন তথা স্বাধীনতাযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে পড়ার সময়ে আমারও রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। আমি ১৯৬৭ সালে এই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করি এবং সিরাজগঞ্জ কলেজে ভর্তি হই। কলেজেও যুক্ত হই ছাত্রলীগের সঙ্গে। বৃহত্তর পরিবেশে প্রবেশের পর দায়িত্ব বর্তায় আরো বড় পরিসরে রাজনীতি করার। এ সময় বিভিন্ন স্কুলে কমিটি করার জন্য মহুকুমার নেতাদের সঙ্গে যেতাম। বাড়ি কান্দাপাড়া হওয়ায় একটি বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হতো। তখনকার রাজনীতিতে প্রায়ই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে মারামারি হতো ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ও ভাসানী ন্যাপের কর্মী-সমর্থকদের। সেসব মারামারিতে আমাদের গ্রাম অগ্রণী ভূমিকা রাখত। এ সময় আমাকে সহযোগিতা করতেন আমাদের গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আজাহার মণ্ডল, তোফাজ্জল হোসেন, আব্দুল আওয়াল, ইউসুফ আলী, আলী ইমাম দুলুসহ আরো কয়েকজন।

কলেজে ভর্তি হওয়ার বছরেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমাকে সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে ছাত্রলীগের প্যানেলে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ, মতিয়া গ্রুপ ও এনএসএফকে পরাজিত করে আমরা খুব সহজেই নির্বাচিত হই। তখন কলেজের অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। আইয়ুব খানের গোলাম বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। আইয়ুবীয় স্বৈরশাসকের মতোই তিনি আমাদের শায়েস্তা করতে চাইলেন। আমি এবং এলিজা সিরাজী ছাড়া ভিপি আব্দুল লতিফ মির্জাসহ সবাইকে তিনি ফোর্স টিসি দিয়ে কলেজ থেকে বহিষ্কার করেন। ছাত্র সংসদের তহবিল খরচ থেকে শুরু করে সকল ক্ষমতা নিয়ে নেন নিজের হাতে। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা তা মানবে কেন? আমরা তার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলি। সে আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশ কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর বেধড়ক লাঠিচার্জ করে, নিক্ষেপ করে কাঁদানে গ্যাসও। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সাধারণ ছাত্ররা। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে মারপিট। মারামারি ছড়িয়ে পড়ে শহরেও। এ ঘটনার পর সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে অধ্যক্ষ কামরুজ্জামান। বিজয়ী হয় সাধারণ ছাত্ররা।

’৬৯-এ ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগের প্রভাব দ্রুত সবখানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময়ে আমি এইচএসসি পাস করে ভর্তি হই বিএ ক্লাসে। সে বছরে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ভিপি পদে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। জিএস পদে মনোনয়ন পান আমির হোসেন খান (রতনকান্দি)। নির্বাচনে খুব সহজেই আমাদের প্যানেল জয়ী হয়। এই প্যানেলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তারা হলেন-লুৎফর রহমান মাখন (বেলকুচি), আজিজুল হক বকুল (কাজীপুর), রফিকুল ইসলাম (চিলগাছা), হাফিজা খাতুন (শহর) প্রমুখ। এরপরই আসে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। আমাদের আসন থেকে এমএনএ পদে মোতাহার হোসেন তালুকদার, এমপিএ পদে সৈয়দ হায়দার আলী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। আমরা ছাত্রলীগের সকল নেতাকর্মী নাওয়াখাওয়া ভুলে গ্রামে গ্রামে ভোট ভিক্ষা করি। ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সারা দেশের মতো আমরাও বিপুল ভোটে বিজয়ী হই।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের ১৬৮টি আসন পেয়ে পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়। পাকিস্তানের পরবর্তী সরকার গঠনের সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু আমরা কর্মীরা মনে করতাম, পাকিস্তানের সামরিকজান্তা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা দেবে না। এ জন্য তারা নানা ষড়যন্ত্রে মেতে উঠবে, তাই আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। আমরা স্বাধীনতার ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠি। মনে করতে থাকি যে-কোনো সময় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেবেন। শুরু হবে সশস্ত্র লড়াই। এ জন্য আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখতে থাকি জাতীয় রাজনীতির দিকে, প্রতিদিনই জমজমাট রাখতে থাকি কলেজ ছাত্র সংসদের অফিস, মিছিল করি শহরে।

১ মার্চ ১৯৭১। অন্যান্য দিনের মতোই প্রায় সব ছাত্রনেতা সিরাজগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদ অফিসে বসে আড্ডা দিচ্ছি। দুপুরে রেডিওতে বিশেষ ঘোষণা প্রচার করা হয়। বলা হয়, ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন বসার কথা, তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এটা যে বাঙালিদের দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ষড়যন্ত্র তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ছাত্রনেতারা সবাই সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদে মিছিলের সিদ্ধান্ত নিই। প্রধান হোস্টেল থেকে বের করে নিয়ে আসি ছাত্রদের। প্রায় একশ ছাত্রের মিছিল বের হয় কলেজ থেকে। মিছিল শহরে ঢোকার পর থেকেই লোক বাড়তে থাকে। দলমত নির্বিশেষে মানুষ যোগ দিতে থাকে মিছিলে। মিছিলের প্রধান স্লোগান ওঠে-‘জয় বাংলা’, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। একশ ছাত্রের মিছিল শহর ঘুরে কলেজ মাঠে ফিরে আসতে আসতে হয়ে ওঠে সহস্রাধিক জনতার মিছিল। আমরা সকল ছাত্রনেতা সেই জনতাকে সামনে রেখে শপথ নিই, বাংলাদেশকে স্বাধীন না করে আমরা কেউ ঘরে ফিরব না।

পরের দিন ঢাকায় স্বাধীনতার নতুন পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হয়, ৩ মার্চ ঘোষণা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করেন-‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে শত্রুর মোকাবিলা করার আহ্বান জানান। এ ভাষণ শুনে আমরা আমাদের স্বাধীনতার ইশারা পেয়ে যাই। পরিকল্পনা করি অস্ত্র প্রশিক্ষণের। যোগাযোগ করি স্থানীয় আনসার সদস্য আব্দুর রহমান (তাড়াশ), জাকির হোসেন (সয়াগোবিন্দ), বাহাদুর হোসেন (হোসেনপুর) প্রমুখের সঙ্গে। তারা আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হন। ৭ মার্চের দু-একদিন পরেই সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠে শুরু হয় অস্ত্র প্রশিক্ষণ। ছাত্ররা দলে দলে এসে নাম লেখায়। প্রথমে শরীরচর্চা আর রোভার্স স্কাউটের ডামি রাইফেল দিয়ে শুরু হয় প্রশিক্ষণ।

প্রশিক্ষণ চলাকালে একদিন আমরা ছাত্রনেতারা বসে আছি কলেজ ছাত্র-সংসদ অফিসে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক দীর্ঘদেহী সদস্য এসে আমাদের স্যালুট জানালেন। বললেন, আমি লুৎফর রহমান, বাড়ি গাইবান্ধায়। ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছিলাম। আপনাদের সিরাজগঞ্জে এসেছি আমার বোনকে দেখতে, তার বিয়ে হয়েছে কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের মোরগ্রামে। কয়েকদিন ধরে সিরাজগঞ্জে আসি ছাত্রদের প্রশিক্ষণ দেখতে। আজ এসেছি আপনাদের কাছে। আপনাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। এটাকেই নিজের এলাকা মনে করে এখানেই থেকে যাব, মুক্তিযুদ্ধ করব। গড় গড় করে এক টানে কথাগুলো বলে থামলেন তিনি। পাকিস্তান আর্মির সদস্য বলে নানা জন নানা প্রশ্ন করতে থাকে। আমি লুৎফর রহমানকে আমার পাশে নিয়ে বসাই। নানা কথা জিজ্ঞেস করে তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ানোর কথা বলি। তিনিও খুশি মনে রাজি হন। তাকে তখন সিরাজগঞ্জ কলেজ মাঠের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে লুৎফর রহমান (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার নামের সঙ্গে ছদ্মনাম যুক্ত হয়, অরুণ। তিনি পরিচিত লাভ করে অরুণ ওস্তাদ হিসেবে) হয়ে ওঠেন সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের একজন অপরিহার্য মুক্তিযোদ্ধা, সিরাজগঞ্জের ঘরের ছেলে। এর দু-একদিন পরেই রবিউল ইসলাম নামে এক বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্য আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হন। মু্ক্তিযুদ্ধ চলাকালে রবিউল গেরিলা হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। আমাদের প্রশিক্ষণে যুক্ত হন সিরাজগঞ্জের তৎকালীন এসডিও একে শামসুদ্দিন ও এসডিপিও আনোয়ার উদ্দিন লস্কর। তারা প্রতিদিনই আসতে থাকেন প্রশিক্ষণ দেখতে। এক সময় কয়েকটি আসল থ্রি-নট-থ্র্রি রাইফেলও সরবরাহ করেন তারা। আমরা হয়ে উঠতে থাকি পুরোদমে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা।

আমরা তখন প্রায় সকল ছাত্রনেতা পড়ে থাকি কলেজ ছাত্র-সংসদে। যখন খাওয়া বা একটু ঘুমের দরকার পড়ে, তখন কলেজের হোস্টেলে খেয়ে বা একটু ঘুমিয়ে নেই। ২৫ মার্চ, গভীর রাত। সংসদ অফিসে বসে আছি সবাই। হন্তদন্ত হয়ে এসডিও শামসুদ্দিন ও এসডিপিও আনোয়ার উদ্দিন লস্কর আমাদের অফিসে আসেন। উত্তেজনায় তারা কাঁপছিলেন। টেবিলের ওপর একটি কাগজ মেলে ধরে বললেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণা এসেছে পুলিশের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। এই যে ঘোষণার কাগজ। আমরাও উত্তেজিত হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি কাগজের ওপর, সবার হাতে হাতে ঘুরতে থাকে সে কাগজ। পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করি যে, রাতেই সে কাগজ ছাপিয়ে ফেলব, ভোর হওয়ার আগেই বিলি করা হবে জনতার মাঝে। তখনই তা বড় পুলের পশ্চিমের মাথায় নুরে এলাহী প্রেসে ছাপানোর ব্যবস্থা করা হয়। সঙ্গে মাইকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়।

২৬ মার্চ সিরাজগঞ্জ শহর যখন স্বাধীনতার উৎসবে মাতোয়ারা তখন আমরা ছাত্রনেতারা এসডিও শামসুদ্দিন ও এসডিপিও আনোয়ার উদ্দিন লস্করের সঙ্গে বৈঠকে বসি। আলোচনার বিষয়, এখন ঢাকা থেকে পাকসেনারা ছড়িয়ে পড়বে মুক্ত বাংলাদেশের দখল নিতে। তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণের পথ হিসেবে চিহ্নিত করি সড়কপথে বাঘাবাড়ী এবং নৌপথে যমুনা হয়ে। আমরা একটি গ্রুপ বাঘাবাড়ী আর এক গ্রুপ যমুনার পাড় প্রতিরোধের ব্যবস্থা করি। আমি, আব্দুল লতিফ মির্জা, লুৎফর রহমান অরুণ একটি বড় মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে চলে যাই বাঘাবাড়ীতে। অন্যরা থেকে যায় যমুনার পাড় পাহারা এবং শহরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে।

আমরা বাঘাবাড়ীতে গিয়ে বাংকার খুঁড়ে বসে যাই হানাদার বাহিনী প্রতিরোধে। আমাদের সকল কাজে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে শাহজাদপুর কলেজের ছাত্রনেতারা। তারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডাল-ভাত রান্না করে এনে খাইয়ে এবং বাংকার খুঁড়ে দিয়ে সহযোগিতা করে। এদিকে হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে বিভিন্ন বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। তাদের কাছে শুনতে থাকি পাকবাহিনীর ভয়াবহ নির্যাতনের খবর। পাশাপাশি প্রতিরোধের খবর। তাদের কাছে পাওয়া খবরে হানাদার প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হয়। কিন্তু বুঝতে পারি যে, আমাদের অস্ত্র ওদের অস্ত্রের তুলনায় খেলনা হাতিয়ার, তবুও আমাদের মনোবল অটুট থাকে। এ সময় নওগাঁ-বগুড়া থেকে ইপিআরের একটি দল আসে বাঘাবাড়ীতে। তাদের সহযোগিতা ও পরামর্শে আরো কিছু বাঙ্কার খোঁড়া হয়। দু-এক দিন আমাদের সঙ্গে থেকে তারা সিদ্ধান্ত নেয় নগরবাড়ী-পাবনা রোডের কাশীনাথপুরে পাকসেনাদের প্রতিরোধ করার। আমরা থেকে যাই বাঘাবাড়ীতেই। পরে খবর পাই, কাশীনাথপুরের ডাব বাগানে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে ইপিআরের সঙ্গে পাকসেনাদের। শহীদ ও আহত হয়েছে অনেক ইপিআর। এসডিও শামসুদ্দিন, আমিসহ আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ডাব বাগানে যাই। সেখানে বেশ কয়েকজন আহতকে উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে আলী নামের এক ইপিআর সদস্যকে নিয়ে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। তার বাড়ি সম্ভবত নোয়াখালী এলাকায়। এরপর থেকে আমাকে সিরাজগঞ্জ কলেজ হোস্টেলে অবস্থান নিয়ে এসডিও সাহেবের সঙ্গেই থাকতে হয়।

একসময় অস্ত্রের সীমাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন কারণে এসডিও শামসুদ্দিন বাঘাবাড়ী থেকে উঠে গিয়ে ঘাইটনা রেল সেতুর কাছে পজিশন নিতে বলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ঘাইটনা রেলসেতুতে যখন পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ হয় তখন আমি সিরাজগঞ্জে। সম্ভবত ২৬ এপ্রিল বিকেলের দিকে এসডিও শামসুদ্দিন সাহেব জানান, তোমাদের শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সিরাজগঞ্জ শহরে মিলিটারি চলে আসবে যে-কোনো সময়। আমিও শহর ছেড়ে টাঙ্গাইল যাব, সেখানে মায়ের সঙ্গে দেখা করে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব রতনকান্দি-কাজীপুর এলাকায়। কলেজ হোস্টেলে আমরা তখন প্রায় ১৬/১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান করছিলাম। তার নির্দেশে আমরা চলে যাই রতনকান্দি ইউনিয়নের চিলগাছা গ্রামে ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলামের বাড়িতে। অপরদিকে শহরে অবস্থানরত এবং বাঘাবাড়ী-ঘাইটনা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারা সে রাতেই শহর ত্যাগ করে উত্তরের দিকে চলে যায়। এ সুযোগে সে রাতেই ন্যাশনাল ব্যাংক লুট করার চেষ্টাসহ জেলখানার অবাঙালি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায় স্বাধীনতাবিরোধীরা।

শহর ত্যাগ করে উত্তরের দিকে যাওয়া প্রায় দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা মিলিত হই ছোনগাছার একটি মাঠের মধ্যে। নেতৃবৃন্দের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, এখন ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গেরিলা কৌশলে যুদ্ধ করতে হবে। কতদিন যুদ্ধ চলবে তার কোনো ঠিক নেই। তাই, তার আগে সবাই যার যার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিয়ে আসতে হবে। সাত দিন পরে আবার আমরা মিলিত হব এখানেই। তখন পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। এ বলে সবাইকে বিদায় দেওয়া হয়। যে যার সুবিধামতো ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। তার আগেই আমাদের অস্ত্রশস্ত্র অনেক যত্ন করে ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলামের বড় ভাই কামাল মিলিটারির সহযোগিতায় পুঁতে রাখা হয়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আমার কাছে ছিল মাত্র ছয়টি গ্রেনেড।

 

অনুলিখন : সাইফুল ইসলাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads