• রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ইউনিয়ন পরিষদ ও জনসাধারণের প্রত্যাশা

  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আলমগীর হোসেন

 

 

ইউনিয়ন পরিষদ বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন প্রশাসনিক ইউনিট। গ্রামীণ পর্যায়ে প্রতিটি এলাকা তথা সে এলাকার জনগণ কোনো না কোনো ইউনিয়নের আওতাভুক্ত। স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। আর এই ইউনিয়ন পরিষদগুলোকে গ্রামীণ মানুষের উন্নয়ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসেবে ধরা যায়।

ব্রিটিশদের আগমনের আগে তৎকালীন বাংলায় স্থানীয় সরকারের অংশ হিসেবে অনেক গ্রামেই পঞ্চায়েত প্রথা চালু ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে লর্ড মেয়ো ১৮৭০ সালে চৌকিদারি আইন চালু করেন। এ আইন দ্বারা প্রতিটি গ্রামে পাহারা টহল ব্যবস্থা চালু করার জন্যে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি করে ইউনিয়ন গঠিত হয়। এ প্রক্রিয়া কয়েকবার পরিবর্তন হয়ে পরবর্তী সময়ে একটি স্থানীয় সরকার ইউনিটের ধারণা সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে রাষ্ট্রপতি আদেশ নং ২২, ১৯৭৩ অনুযায়ী ইউনিয়ন পঞ্চায়েতের নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় ইউনিয়ন পরিষদ। সর্বোপরি ১৯৮৩ ও ১৯৯৩ সালের স্থানীয় সরকার (ইউপি) অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ভোটে একজন চেয়ারম্যান, ৯ জন সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত আসনে ৩ জন মহিলা সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করা হয়। এই ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদকাল করা হয় ৫ বছর। আর সেই বিধিমালা বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রেও বহাল রয়েছে।

গ্রামীণ অবকাঠামো, মানুষের জীবনমান, সামাজিক সম্পর্ক, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষার গুণগতমান, সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে ইউনিয়ন পরিষদ। আর ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করে পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্যরা। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ইউনিয়নের সার্বিক উন্নয়নের শপথ নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে। আর স্থানীয় জনসাধারণ ইউনিয়নের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে প্রতিনিধিদের শপথ ও জনসাধারণের প্রত্যাশার কতটুকু পূরণ হচ্ছে তা সবারই একটু চিন্তা করা জরুরি।

গণতান্ত্রিক দেশের নীতি অনুসারে, প্রতি পাঁচ বছর পর পর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে দেশের সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। তেমনিভাবে স্থানীয় নির্বাচনের চিত্র তথা ইউপি নির্বাচনের চিত্রটিও অনেকাংশে পাল্টে গেছে। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে ইউপি নির্বাচন সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনায় একটু ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। পূর্ববর্তী সময়ের প্রার্থীদের মানসিকতা, চিন্তাভাবনা আর বর্তমান প্রার্থীদের মানসিকতা অনেকাংশে পরিবর্তন হয়েছে। ফলে এখনকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জনসেবা, অবকাঠামোগত সুষ্ঠু উন্নয়ন কেন জানি গৌণ বিষয় হয়ে পড়ছে। জনপ্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষা, রাজনৈতিক ফায়দা লোটার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফলে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন খুবই নগণ্য পরিমাণে লক্ষ করা যায়। দেশের  সার্বিক উন্নয়ন হলেও স্থানীয় প্রতিনিধিদের নীতিগত কার্যক্রমের অভাবে গ্রামীণ এলাকায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে না।

২০১৬ সালে মার্চে প্রথম ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে অনুসারে ৫ বছর পর এ বছর মার্চে নির্বাচন হওয়ার কথা। যদিও এ বছর করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে তারিখ পিছিয়ে যেতে পারে। তথাপি গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর বা এর আগে থেকেই প্রত্যেক গ্রাম্য এলাকায় ইউপি নির্বাচনের আলোচনা লক্ষ করা যাচ্ছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীরা অনেকেই মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে পোস্টার, ব্যানারে বা মাঠে সরাসরি প্রচারণা চালাচ্ছে। পূর্ববর্তী সময়ের নির্বাচনী প্রার্থীদের এখনকার প্রার্থীদের মতো এত নির্বাচনকালীন ব্যয়বহুলতা লক্ষ করা যেত না। আর বর্তমানে স্থানীয় নির্বাচনে কিছু ওপেন-সিক্রেট বিষয় আছে। যে বিষয়গুলো এখন কারো অজানা নয়। যা হোক, নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা যে ইশতেহার দিয়ে জয়লাভ করে, সে ইশতেহারের শতভাগ বাস্তবায়ন হলে একটি মানসম্পন্ন গ্রামীণ পরিবেশ গড়ে উঠত।

আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়ায় স্থানীয় সরকারের দুর্নীতির চিত্র দেখতে পাই। আর সেখানকার বাস্তব চিত্র আরো ভয়াবহ। তবে ব্যতিক্রম অনেক স্থানীয় প্রতিনিধি আছে যারা জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকে। তাদেরকে অবশ্য পরবর্তী নির্বাচনের সময় কোনো ইশতেহার দিতে হয় না। এমনিতেই তারা জনগণের আস্থা অর্জন করে নির্বাচিত হয়। গ্রামীণ জনগণের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে সরকারী প্রদত্ত প্রকল্প, কর্মসূচি, ত্রাণ, সেবা এবং বাস্তবে তার বাস্তবায়ন কতটুকু তা পর্যালোচনা করা জরুরি। বাংলাদেশের অনুন্নত, প্রান্তিক, প্লাবিত অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন অন্যদের থেকে অনেকটা কষ্টকর। সরকার সেসব এলাকার মানুষের সুষ্ঠু যোগাযোগ, পরিমিত খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্যে সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু স্থানীয় প্রতিনিধিদের হস্তক্ষেপের ফলে অনেক সময় সরকারের এসব উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। ফলে সেসব পশ্চাৎপদ এলাকার মানুষ ভালো যোগাযোগব্যবস্থা, খাদ্য, স্বাস্থ্য সুবিধা, শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়।

সরকার গ্রামীণ যোগাযোগ উন্নয়নের জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে কাবিখা, কাবিটা, এলজিডি, এলজিএসপি, টিআরও ইত্যাদি কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য। দরিদ্র মানুষের খাদ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্যে ভিজিডি, ভিজিএফ, জিআর, কাবিখা, আরএমপি ও বিভিন্ন ত্রাণ সহায়তা কর্মসূচি প্রদান করা হয়। স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিটি গ্রামীণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা সরঞ্জামাদি সরবরাহ করা হয়। হতদরিদ্র এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের জন্যে ভ্রাম্যমাণ স্কুল, শিশুদের বৃত্তি প্রদান, বয়স্ক শিক্ষা চালু করা হয়ে থাকে। আর এসব কার্যক্রম স্থানীয়ভাবে ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। আর বর্তমানে সরকারের সেসব কার্যক্রম অনেক সময় বাস্তবায়ন না হওয়ায় সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে অন্যতম গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো গ্রামের সাধারণ মানুষ। সেসব সাধারণ মানুষ সরকারি সেবা থেকে বার বার বঞ্চিত হওয়ার ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ছে। একদিকে প্রতিনিধিরা তাদের নিজ স্বার্থ হাসিল করে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। যার বাস্তব ফলাফল হলো বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি। যতদিন গ্রামের মানুষদের অধিকার আদায় না হচ্ছে, মানুষের সার্বিক উন্নয়ন না হচ্ছে ততদিন দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে এ দেশ বাঁচতে পারবে না।

দেশের গ্রামের মানুষের সার্বিক উন্নয়ন সাধনের জন্যে সরকার ও জনগণের সচেতন হওয়া দরকার। সরকারের উচিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যোগ্য ব্যক্তিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া, অন্য দলগুলোর ও তাদের মনোনীত ব্যক্তিদের ব্যাপারে তলব করা দরকার। আর সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থের বিনিমিয়ে ভোট প্রদান থেকে বিরত থেকে যোগ্য, সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা। ইউনিয়ন পরিষদগুলো সরকারের প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করছে কি না, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তা খতিয়ে দেখা উচিত। তাহলে সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে ভাসবে দেশের প্রতিটি এলাকা, গ্রাম ও পাড়া। আর তখনই গ্রামের অবহেলিত, দুস্থ তথা সবার অধিকার আদায় হয়ে তাদের প্রত্যাশাগুলো পূরণ হবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads