• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আমাদের বিজয় বিশ্বমানবতারই বিজয়

  • প্রকাশিত ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

রুহুল আমিন প্রামাণিক

 

 

 

রুহুল আমিন প্রামাণিক; একজন প্রতিথযশা কবি, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। থাকেন রাজশাহীতে। এখানকার শাহ্ মখদুম দরগা-অফিসে, শীতের রোদমাখা এক দুপুরে তাঁর সঙ্গে আলাপ জমিয়েছিলেন বাংলাদেশের খবরের সহ-সম্পাদক অর্বাক আদিত্য ও লেখক নাজমুল হাসান। যেখানে প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে— বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু-ভাবনা। পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে এদেশের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ানটিও এই বহুদর্শী চিন্তক মুক্তিযোদ্ধা অসংকোচে প্রকাশ করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সেসব তথ্য ও তত্ত্ব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের খবর-এর পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো।

 

প্রশ্ন : আমাদের জানা আছে— একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আপনাদের যুদ্ধে যেতে হয়েছিল। যার প্রায় আড়াই দশকের পটভূমি রয়েছে। যেখানে সংগ্রাম হয়েছে, প্রমাণ হয়েছে পাকিস্তান ভুয়ো ছিলো। যেমনটা আপনারা চাননি। সবচেয়ে বড় কথা, এর সঙ্গে আপনাদের স্বপ্ন জড়িয়ে ছিল। আপনারা কেমন দেশ চেয়েছিলেন?

রুহুল আমিন প্রামাণিক : আমরা যারা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম, তারা বায়ান্ন, ঊনসত্তর; এই মাইলফলকগুলো ছুঁয়ে এসেছিলাম। ফলে একটি রাষ্ট্র গঠন হয়েছিল, বাঙালির আত্মশ্লাঘাবোধের ভেতর দিয়ে। যখন সংস্কৃত ভাষার প্রচণ্ড প্রতাপ ছিল, তখন বাঙালিরা নিজের ভাষায় ধর্মচর্চা করেছে, তার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করেছে। ‘চর্যাপদ’ তার উদাহরণ। একটা ভাষার ভেতর দিয়ে যখন আত্মানুসন্ধান করে তখন বোঝাই যায় এই জাতির আত্মশ্লাঘাবোধ শুরু থেকেই ছিল। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ঐতিহাসিক একটা অবস্থান থেকে হয়েছিল। ’৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু এবং তার বন্ধুবান্ধব সিরাজদ্দৌলা হলে বসে ভাষার প্রশ্নে মিটিং করেছিলেন। এই তথ্য বদরুদ্দীন উমরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বইতেও আছে। পাকিস্তানকে আমরাই প্রতিষ্ঠা করেছি, কিন্তু ক্রমান্বয়ে সেই পাকিস্তান তো আমাদের স্বপ্নবিচ্যুত করেছে। এখানে রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা আসে : ‘রূপনারানের কূলে জেগে উঠিলাম, জানিলাম এ জগত সত্য নয়’ আমরাও পদ্মা মেঘনার কূলে জেগে উঠলাম জানলাম এ পাকিস্তান সত্য নয়। রক্তের অক্ষরে দেখিলাম, রক্ত দিয়েছি বায়ান্নতে। আবার রাজশাহীতে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল জেলখানার ভেতর সাতজন দেশপ্রেমিককে হত্যা করা হলো। সেখানে ৫০ জনের মতো আহত হয়েছিল। তারপর বাঙালি ক্রমে জেগে উঠল, বুঝল আমরা শতাব্দী লাঞ্ছিত জাতি। বাঙালির এই আত্মমর্যাদার বোধকে মুজিবভাই সংগঠিত করলেন। এবং, দারুণভাবে।

প্রশ্ন : বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেন?

রুহুল আমিন প্রামাণিক : বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিন্তু কোনো আগ্রাসী স্বভাব দ্বারা আক্রান্ত নয়। জার্মানি যেমন গোটা বিশ্বকে দখল করতে চায়, বাঙালির জাতীয়তাবাদ কিন্তু তা নয়। বাঙালিরা নিজের মায়ের আঁচলেই বিশ্বমায়ের আঁচলকে দেখেছিল। ভাষার প্রশ্নে বাঙালির চাওয়া ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, সেখানে কিন্তু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা চাওয়া হয়নি। যদিও আমরা ৫৬ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী ছিলাম। কাজেই বাঙালির এই সহিষ্ণু জাতীয়তাবাদকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা আমাদের সমর্থন করেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ তো সমর্থন করেছিল। আমেরিকার নেতৃত্ব সমর্থন করেনি, কিন্তু সাধারণ মানুষ করেছিল। মাথা অবনত করেছে, সম্মান দিয়েছে। সাহায্য করেছে সহযোগিতা  করেছে, সহমর্মিতা জুগিয়েছে। এটা আজো অব্যাহত রয়েছে— কেননা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেইসব মানুষকে নিয়ে এসে সম্মান জানাচ্ছেন। এতে বোঝা যায় আমাদের জাতীয়তা কোনো গ্রেট সভ্যেনিজম দ্বারা আক্রান্ত নয়। কাজেই আমাদের যে বিজয় এটা বিশ্বমানবতারই বিজয়।

প্রশ্ন : পাকিস্তান আমলের চব্বিশ বছরের সংগ্রামকে কীভাবে দেখবেন?

রুহুল আমিন প্রামাণিক : পাকিস্তানের ২৪ বছর বাঙলি যে সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ একটা উদাহরণ দিই— এই ২৪ বছরে বাঙালিরা জেল খেটেছে হাজার বছরের সমান। এটা কী করে হয়? বঙ্গবন্ধু যেমন নিজের যৌবনের ১৩-১৪ বছর জেল খেটেছেন। আমার বড়ভাই অ্যাডভোকেট মহসিন প্রামাণিক ৬-৭ বছর জেল খেটেছেন। শ্রমিকনেতা জসিমউদ্দিন মণ্ডল জেল খেটেছেন ১৬ বছর। খুলনার রতন সেন ২৩ বছর জেল খেটেছেন। মুক্তিকামী মানুষ মাথায় হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে। সব মিলিয়ে হাজার বছর হবে। তৃতীয় বিশ্বের যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন; সেই ত্যাগের জায়গায় বাংলাদেশ সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে।

প্রশ্ন : আপনারা যুদ্ধ থেকে ফিরে কেমন দেশ চেয়েছিলেন? জাতীয় চার নীতির ভিত্তিতে হোক বা দেশের মানুষ কেমন থাকবে, সমাজব্যবস্থাটা কেমন হবে, রাজনীতি কেমন হবে, নাগরিকরা অধিকার পাবে কী-না- এসব জায়গাগুলো আপনি যদি বলেন?

রুহুল আমিন প্রামাণিক : একাত্তর সালে পাকিস্তান দেশটাকে জ্বালিয়ে দিল। ইয়াহিয়ার পোড়ামাটি নীতির মাধ্যমে শিক্ষক ছাত্র বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো। আধুনিক যুগে কোনো মানুষ এমন নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। একটা গণহত্যার রাজনীতি আমাদের ওপর চাপিয়ে দিল। গণহত্যা আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেখেছি— তার থেকে ভয়াবহ গণহত্যার রাজনীতি বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে, যা জনসংখ্যার ঘনত্বের দিক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক ঘটনাধারাকে ছাড়িয়ে যায়। আর ধর্ষণ, নারী-শিশুহত্যা, লুণ্ঠন অকল্পনীয়। আমরা গবেষণা করতে গিয়ে দেখছি ধর্ষণ ৮-১০ লাখে চলে যায়। এত বড় ধর্ষণ তাও আবার নয় মাসে পৃথিবীতে আর কোথাও ঘটেনি। এতসব আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে পাওয়া দেশটি হবে মানুষের, আদর্শের। শোষণমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ প্রতিটি পল-অনুপলে বলবে সবার উপরে মানুষ সত্য। এখানে কোনো সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, অসাম্য-বৈষম্য থাকবে না। এই আকাঙ্ক্ষা শুধু স্বপ্ন নয়, এটা প্রত্যেক মানুষের ভেতরে লালিত হয়েছিল। নতুন লড়াই আমরা শুরু করেছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নিয়ে। যেখানে কোনো রাস্তাঘাট ছিল না, ব্রিজ কালভার্ট ছিল না, ঘরবাড়ি ছিল না, স্কুল-কলেজ ছিল না। সব গুঁড়িয়ে দিয়েছে, এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়েছিল, সেই ভাঙাচোরা মুখথুবড়ে পড়া একটি দেশকে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু যে অবস্থানে নিয়ে এসেছিল, তা তো বাংলাদেশবিরোধীরা সহ্য করতে পারল না। তাকে নির্বংশ করার জন্য ১৫ আগস্ট সংঘটিত করল। এর পরই আমাদের আশাভঙ্গ হলো। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলোকে নষ্ট করা শুরু হলো। প্রথমেই সংবিধানে হস্তক্ষেপ করা হলো। চার যে জাতীয় মূলনীতি সেটাকে ভেঙে দিল। পাকিস্তানের দিকেই যাত্রা শুরু করল। এটা ২১ বছর ধরে চলল। অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার।

প্রশ্ন : বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যে যুগ শুরু হলো। এই সময়টার প্রতিচ্ছবি নিয়ে যদি কিছু বলেন।

রুহুল আমিন প্রামাণিক : জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা এটা ঠিক আছে। কিন্তু তার কার্যকলাপে মনে হয় তার যে ভূমিকা এটা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা। দেশের যদি সবচেয়ে বড় কোনো ক্ষতি করে থাকে তো এই মুক্তিযোদ্ধা, যাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি চুক্তিযোদ্ধা। রাজনীতি বি-রাজনীতিকীকরণ করেছেন, ‘পলিটিকস ডিফিকাল্ট’ শব্দটা তো তিনি ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক কেনা-বেচা শুরু করেছেন। ছাত্ররা তো সমগ্র জাতিকে জাগ্রত করেছে, সেই ছাত্রদেরই তো নষ্ট করে দিয়েছেন। হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে, বিলাসবহুল জাহাজে করে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে। ছিয়ানব্বইয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে এসে ফেরাতে চাইলেন প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে। কিন্তু কারসাজি করে, ভোটে অনিয়ম করে তাকে হারানো হয়েছে। আজ এই ডকুমেন্টগুলো বের হয়েছে। এরপর আমরা তাকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে এলাম। তারপর, অগ্রযাত্রা আবার নতুন করে শুরু হলো, যা আজ অবধি চলছে। কিন্তু আমরা যারা জাতীয় মুক্তি আন্দোলেনর সাথে যুক্ত ছিলাম এবং বেঁচে আছি, তাদের এখনো নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়। কেন? এদেশে দুর্নীতি বেড়েছে, রাজনীতি যারা করছেন তারা কি রাজনীতি করছেন? নাকি ব্যবসা করছেন? যারা রাজনীতি করছেন তাদের আদর্শটা কী? তারা কি এদেশের নেংটিপরা ছলিমুদ্দি কলিমুদ্দি জগাই মাধাই— এদের সম্পর্কে কোনো কিছু চিন্তা করছে? আমরা যাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, আজ দেখা যাচ্ছে তাদের মতোই তারাও আঙুল ফুলে কলাগাছ। কলাগাছ থেকে বটগাছ। বটগাছ থেকে জোড়াবটগাছ। শাসকের চরিত্রগত বদলটা ওভাবে ঘটেনি।

প্রশ্ন : আশার জায়গাটা একেবারে বিনষ্ট হয়েছে বলছেন?

রুহুল আমিন প্রামাণিক : না, এখনো আমরা আশাবাদী। এদেশের জনগণ, তারা জাগ্রত, তারা দেশকে খাওয়াচ্ছে, পরাচ্ছে, অন্ন জোটাচ্ছে। আর ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ১০ লাখ মাবোনের ইজ্জত— এই ত্যাগ কেউ ভুলিয়ে দিতে পারে না। ত্যাগের ঋণটাই আমাদের বড় শক্তি। আজো বেঁচে আছে বঙ্গবন্ধুর রক্তকণা শেখ হাসিনা। তিনিই আমাদের ঠিকানা। আমরা আশাবাদী বাংলাদেশে সেই পরিবর্তনটা হবে, যেটা বঙ্গবন্ধু চেয়েছেন। প্রকৃত সোনার বাংলা গড়ে উঠবে।

প্রশ্ন : আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

রুহুল আমিন প্রামাণিক : দৈনিক বাংলাদেশের খবর, যে উদ্যোগটা নিয়েছে, সাধুবাদ পাওয়ার মতো। বাংলাদেশ একদিন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ হবে। এই অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের খবর যুক্ত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে আমি আন্তরিক মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads