• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

গণতন্ত্র সূচক এবং বাংলাদেশ

  • প্রকাশিত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আল আমিন ইসলাম নাসিম

 

 

প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ভূমিকা অপরিসীম। মূলত গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র বলা হয় নির্বাচনকে। আর সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা। অথচ সেটিই যেন বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। দৈনিক পত্রপত্রিকা খুললেই আমাদের নজর কাড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে একে অপরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়ি, মন্তব্য ও প্রতিহিংসার রাজনীতি। ফলে দিন দিন গণতন্ত্র ফিকে হচ্ছে। ক্ষুণ্ন হচ্ছে মানবাধিকার। নতুন করে প্রশ্ন উঠছে নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, নির্বাচন ও ভোটাধিকার নিয়ে। তদুপরি নির্বাচনি ব্যবস্থা ও বহুদলীয় অবস্থান, নাগরিক অধিকার, সরকারে সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ—এসব মানদণ্ডে নতুন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।

প্রসঙ্গত যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর ২০২০ সালের তথ্য থেকে জানা যায়, গণতন্ত্রের সূচকে আবারো ‘হাইব্রিড রেজিম’ বা মিশ্র শাসনের দেশের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে গত বছরের তুলনায় চার ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এই বছরের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান চার ধাপ এগিয়ে হয়েছে ৭৬। তাদের বেঞ্চ মার্ক ১০ পয়েন্টের মধ্যে, এই বছর বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৯৯। তথাপি হাইব্রিড রেজিম মানে নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, যা নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও নিরপেক্ষতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিরোধী দল এবং প্রার্থীর ওপরে সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা। রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যায়, যা ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকেও বেশি। দুর্নীতির বিস্তার প্রায় সর্বত্র এবং আইনের শাসন খুবই দুর্বল। সিভিল সোসাইটি দুর্বল, সাধারণত সাংবাদিকরা হয়রানি ও চাপের মুখে থাকে এবং বিচারব্যবস্থাও স্বাধীন নয়। কার্যত এ বিষয়গুলো আমাদের রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের জন্য অত্যন্ত শঙ্কার!

তথাপি গণতন্ত্রের এই সংকটের পশ্চাতে যে প্রোথিত মূল শিকড়ের মতো কারণগুলো আবির্ভূত হয়েছে তাহলো, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল, জবাবদিহিতার অভাব, সুশাসন ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনসহ আরো কিছু বিষয়। আর এজন্যই অতি দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল নিরসন করতে হবে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পরন্তু দেশে আসন্ন নির্বাচনই এই রাজনৈতিক কোন্দল দূরীকরণের একটি অন্যতম ফ্যাক্টর! আর সে সুযোগটি আমাদের লুফে নিতে হবে। এজন্য দলবল নির্বিশেষে এখনই সবাইকে একত্রিত হওয়া থেকে শুরু করে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়ন, জাতীয় দুর্যোগে একসঙ্গে থাকা, ব্যক্তি স্বার্থকে উপেক্ষা, পুরনো ভুলগুলো সংশোধন, আপসের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, পারস্পরিক দলগুলোর প্রতি আস্থা ও সাধারণ জনগণের জীবনমান প্রভৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পূর্বপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে।

সব নির্বাচনেই ‘লেভেল প্লেয়িং’ ফিল্ড তৈরি করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশন বা ইসিকে নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে তার ক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। সংবিধানের ১১৮ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইসিকে শক্তিশালী ও স্বাধীন থাকার কথা বলা হয়েছে। তদুপরি ইসির নিরপেক্ষহীনতাও রাজনৈতিক কোন্দলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ। পক্ষান্তরে গত ২৬ জানুয়ারির দৈনিক যুগান্তরের অনলাইন জরিপে দেখা যায়, ৯৪.০৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না নির্বাচন কমিশন। ৪.৯৫ শতাংশ মনে করেন, নির্বাচন কমিশন তা পারছে ও ০.৯৯ মন্তব্য নেই। সুতরাং এই বিষয়গুলোও আমাদের জন্য প্রচণ্ড আতঙ্কের। এছাড়া ইতোমধ্যে ইসির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক চিঠি দিয়েছেন নির্বাচনে ভোট কারচুপি ও নির্বাচনে নাশকতাকে কেন্দ্র করে। কার্যত ইসিকে তার গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। রাজনৈতিক কোন্দলের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হবে। তাহলে‌ই অনেকাংশে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

এছাড়া গণতন্ত্র সংকটের পশ্চাতে তুরুপের তাস হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি। অবাধ দুর্নীতির খবরাখবর আমাদের প্রায়‌ হরহামেশাই শুনতে হচ্ছে গণমাধ্যম থেকে। পক্ষান্তরে দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের বছরের তুলনায় আরো দুই ধাপ নিচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’ অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে তালিকার নিচের দিক থেকে বাংলাদেশ ১২তম অবস্থানে আছে, যা মূলত নাজুক অবস্থা সৃষ্টি করেছে গণতন্ত্রের। কেননা দুর্নীতি গণতন্ত্র সংকট সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে ও একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, এ দুটো উপাদান।

উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৩৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে (২৮ ডিসেম্বর ২০২০, দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড)। আর এতে বিশেষজ্ঞরা মতামত দেন, এই অগ্রগতিতে বাংলাদেশ আরো সমৃদ্ধি লাভ করতে পারবে যদি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দলগুলোর কোন্দলগুলো নিরসন করতে পারে এবং ‘গণতন্ত্র’ আলোর পথের পথিক হয়।

সর্বোপরি গণতন্ত্রের এই ভয়াবহ বিপর্যয় রোধে একদিকে যেমন জাতীয়ভাবে কথোপকথনের রাজনীতি সৃষ্টি করতে হবে, অন্যদিকে তেমনি সমকালীন রাজনৈতিক কোন্দল দূরীকরণে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। তাহলেই দেশ ও জাতি প্রকৃত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে এবং সূচিত হবে গণতন্ত্রের নতুন দিগন্ত। পরিশেষে বিশিষ্ট রম্য লেখক জেরাল্ড বারজানের উক্তি টেনে বলতে হচ্ছে, ‘প্রতিটি নির্বাচন থেকে আমরা কি শিখি? আমরা এটাই শিখি যে আগের নির্বাচন থেকে আমরা কিছুই শিখিনি।’ সুতরাং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, আমাদের আসলেই শিক্ষা নিতে হবে, নতুবা গণতন্ত্রের এই সংকট আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য ডেকে আনতে পারে অমানিশার মতো ঘন অন্ধকার রাত।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

alaminislamnasim@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads