• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মনের গহিনে আঁকা যুদ্ধস্মৃতি-দুই

  • প্রকাশিত ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সোহরাব আলী সরকার

 

 

 

আমি আর আবদুল আজিজ সরকার একই এলাকার মানুষ, একত্রিত হলাম দুজন। শফিকুল ইসলাম শফির বাড়ি শহরে, মিলিটারি আসায় সেখানে তার যাওয়ার উপায় নেই, সে-ও এলো আমাদের সঙ্গে। বেলকুচির লুৎফর রহমান মাখন আর চৌহালীর মনিরুল কবীরের বাড়ি অনেক দূরে, আর সেখানে যেতে হলেও আমাদের সঙ্গেই যাওয়া সহজ, তাই পাঁচজন একজোট হয়ে রওনা হলাম আমাদের এলাকার দিকে। এসে উঠলাম, আমার মামা ওসিম উদ্দিন শেখের বাড়ি ভদ্রঘাটের জাঙ্গালিয়াগাঁতি গ্রামে। গ্রামটি একেবারেই যোগাযোগবিচ্ছিন্ন জঙ্গলাকীর্ণ, আমাদের পালিয়ে থাকার জন্য সবচেয়ে উপযুক্তও বটে। সেখান থেকে মনীরুল কবীর, লুৎফর রহমান মাখন আর আজিজ সরকার বাড়িতে গেল। কিন্তু দু’একদিনের মধ্যেই সবাই আবার ফিরে এলো জাঙ্গালিয়াগাঁতিতে। এখন অপেক্ষা, আবার সবাই মিলিত হওয়া এবং পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা। এদিকে পাকসেনারা এসে পুরো শহর পুড়িয়ে দিয়েছে, গ্রামেও হানা দিতে শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামীর মতো স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা, সঙ্গে চোরডাকাত, লুটেরারাও।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পাঁচজন পৌঁছে যাই ছোনগাছার নির্দিষ্ট মাঠে। কিন্তু অন্যরা আসে না। সবাই চিন্তায় পড়ে যাই, খোঁজ নিতে শুরু করি সবার। খুঁজতে খুঁজতে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, অন্যরা ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছে। কে কোন পথে গেছে তার কোনো হদিস পাওয়া যায় না। বুঝতে পারি যে, এ সময় কেউ হদিস রেখেও যাবে না, আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। এখন কোথায় যাব? অবশেষে আবারো মনে পড়ে জাঙ্গালিয়াগাঁতি মামাবাড়ির কথা। চলে আসি সে গ্রামেই। চিন্তা আসে ভারতে যাওয়ার, আমরাও পথ খুঁজতে থাকি, কোন পথে যাওয়া যাবে। কিন্তু ততদিনে স্বাধীনতাবিরোধীরা গ্রামে গ্রামে পাকসেনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে উপদ্রব বেড়েছে ডাকাত লুটেরাদের। এসব থেকে আত্মরক্ষা করতে গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে নিজের গ্রাম, যাতে অপরিচিত কেউ সে গ্রামে ঢুকে ডাকাতি করতে না পারে।

একদিন খবর পাই কালিয়াহরিপুরের ছাত্রনেতা আবদুল হামিদ তালুকদারের। যোগাযোগ করি তার সঙ্গে। পরিকল্পনা করি ভারত যাওয়ার। আলোচনা করে পথ ঠিক করা হয় রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে পার হওয়ার। এ রাস্তা আমাদের একেবারেই অপরিচিত, তারপরেও চাটমোহর পর্যন্ত যেতে হবে রেললাইন দিয়ে। সে রেললাইনে পাকসেনা বহনকারী ট্রেন চলাচল করে। তবু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রেল লাইন ধরে রওনা হই মূলাডুলি চাটমোহরের দিকে। পাবনা-নাটোর-রাজশাহী সড়কের কাছাকাছি পৌঁছার পর এলাকার মানুষ আমাদের সে সড়ক পার হতে বাধা দেয়। তারা জানায়, এ সড়ক দিয়ে পাকসেনাদের গাড়ির বহর সব সময় চলাচল করছে। আর মানুষের ছায়া দেখলেই তারা গুলি করে হত্যা করছে। আমরা নিজেরাও দূর থেকে হরদম গাড়ি চলাচল করতে দেখে আর সাহস পাই না সড়ক পার হওয়ার। ফিরে আসতে বাধ্য হই। ভাঙ্গুড়া যখন পৌঁছি তখন বেলা ডুবুডুবু, এদিকে ক্ষুধার জ্বালায় সবারই অবস্থা কাহিল। এক ছেলেকে ডেকে কয়েক টাকা দিয়ে তাকে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। তার বাবা স্থানীয় স্টেশন মাস্টার। নাম সোহরাব আলী। তিনি আমাদের অনেক যত্ন করেন। এই বিপদের সময় তার এত আদর যত্ন আমাদের ভীত করে ফেলে। মনে হতে থাকে, এ লোক আমাদের পাকসেনাদের হাতে তুলে দেবে না তো? কিন্তু উপায়হীন ক্ষুধার্ত আমরা সেখান থেকে পালাতেও পারি না। খাওয়া-দাওয়া করে সজাগ থেকে সে বাড়িতেই রাত কাটাই। পরের দিন সকালে দেখি, স্টেশন মাস্টার সাব আমাদের জন্য নৌকা ঠিক করেছেন মোহনপুর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য। আমাদের দেওয়া টাকা তো ফিরিয়ে দেনই, সাথে আরো কিছু টাকা ধরিয়ে দেন বিপদ-আপদে খরচ করার জন্য। আমরা সে নৌকায় মোহনপুর এসে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি সেই জাঙ্গালিয়াগাঁতি গ্রামে।

ততদিনে পাকসেনা, স্বাধীনতাবিরোধী, বিশেষ করে ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে গেছে ভীষণভাবে। মনে হতে থাকে, আমাদের উপস্থিতির কারণে ডাকাতেরা ডাকাতি করতে ভয় পাচ্ছে। আবার সশস্ত্র ভেবে আমাদের ওপর হামলা চালানোরও সাহস পাচ্ছে না, ষড়যন্ত্র করছে আমাদের এলাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রয়োজনে আমাদের হত্যাও করতে পারে। অথচ আমাদের কাছে কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও একটি পিস্তল ছাড়া কোনো অস্ত্র নেই। ফলে নিজেদের এবং এলাকাবাসীকে ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষার জন্য অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি ভীষণভাবে। আমার বাবার কাছে একটি টুটু বোর রাইফেল ছিল, তিনি তখন বাড়ি ছেড়ে পরিবারসহ পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। অবস্থান করছিলেন শিয়ালকোল ইউনিয়নের শিবনাথপুর গ্রামে। আমি আমার মামাতো ভাই চান্দুকে নিয়ে শিবনাথপুরে বাবার কাছে থেকে সেই রাইফেলটি চেয়ে নেই। কিন্তু তা বহন করে আনতে গিয়ে এক বিপত্তির মুখে পড়তে হয়। কারণ, স্বাধীনতা বিরোধীরা ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দাদের নামিয়ে দিয়েছে আমাদের বিরুদ্ধে। শিয়ালকোলের স্বাধীনতাবিরোধী মজিবরের জগৎগাঁতি গ্রামের পাশ দিয়ে আসার সময় গ্রামবাসী আমাদের আটক করে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। এ খবর আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার ছাত্ররা মজিবরের বাড়িতে এসে হাজির হয়। তারা আমাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলে। ভয়ে মজিবর বাড়ির ভেতর থেকে বের হওয়ার সাহস পায় না। একসময় বাড়ির ভেতর থেকেই আমাদের ছেড়ে দিতে বলে; কিন্তু আমরাও রাইফেল ছাড়া সে বাড়ি থেকে নামব না বলে পণ করি। অবশেষে রাইফেল ফেরত দিয়ে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আমরা চলে আসি জাঙ্গালিয়াগাঁতি গ্রামে।

একদিন ডাকাত দল আমাদের কাছে চিরকুট পাঠিয়ে তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গ্রাম লুট করার প্রস্তাব দেয়। এটা অনেকটা চ্যালেঞ্জ করার শামিল। এই টুটু বোর দিয়ে ডাকাতদের কতটুকু সামাল দিতে পারব তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। তারা চিরকুট দিয়ে আমাদের পাশের এক গ্রামে হামলা চালায়। আমরাও তাদের প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে যাই। ডাকাতদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারি। তা বিস্ফোরণের পর ওরা পালিয়ে যায়। তখন আমরা ভীষণভাবে রাইফেলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। যদিও চিলগাছা থেকে সবাই মিলিতভাবে ছাড়া অস্ত্র না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল তবু চলে যাই সেখানেই। সেখানে একটি ভরসা ছিল, আমার কাছে থাকা চাইনিজ রাইফেলটি রফিকুলের কাছে দিয়ে বলেছিলাম যে, আমার প্রয়োজনে রাইফেলটি আমি নিতে আসব, এ কারণে রাইফেলটি আলাদা করে রাখা ছিল রফিকুলের কাছে। আমি, মনিরুল কবীর ও আমার এক মামাতো ভাই চলে আসি চিলগাছায়। তাকে জানাই এখানকার পরিস্থিতি, কিন্তু রফিকুল প্রথমে রাইফেল দিতে অস্বীকার করে। অনুনয়, বিনয়, অনুরোধ, বিপদ, কিছুটা রাগারাগি করলে অবশেষে চাইনিজ রাইফেল আর তার গুলিগুলো আমাদের হাতে তুলে দেয় রফিকুল। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাইফেল আর গুলি দিলেও রফিকুল সাফ জানিয়ে দেন, এ পরিস্থিতি তাদের বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। তখন আমরা আরো বিপদে পড়ে যাই। কারণ, ডাকাতের ভয়ে তখন গ্রামে গ্রামে পাহারা বসিয়েছে মানুষ। সেসব গ্রাম পার হয়ে রাতের আঁধারে এতদূর যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবু একটি ছোট্ট শোলার আঁটিতে রাইফেলটি বেঁধে চিলগাছা গ্রাম থেকে বের হই আমরা।

সত্যি সত্যি বিপদে পড়ে যাই ছোনগাছা এলাকায় এসে। গ্রামের লোকজন আমাদের আটক করে এবং স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করে। কিন্তু আমরা জানি যে, স্থানীয় চেয়ারম্যান পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দল পিডিপির সদস্য। তার কাছে নিয়ে গেলে নির্ঘাত পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেবে সে। আমরা তখন এলাকার বাসিন্দা ফ্যাশন টেইলার্সের শফির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে অনুরোধ করি। গ্রামের মানুষ আমাদের শফির বাড়িতে নিয়ে যায়, ভাগ্যক্রমে তাকে পেয়েও যাই। সে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরে। গ্রামবাসীকে বলে, কোনো অসুবিধা নেই, এরা আমার পরিচিত ছাত্রনেতা। আজ রাতে ওরা এখানেই থাকবে, তোমাদের দরকার পড়লে সকালে এসে চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যেও। আমরা গ্রামবাসীর হাত থেকে নিস্তার ও শফির বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে অকূলে কূল পাই। কিন্তু সকালে আবারো আসে গ্রামবাসী। ওরা ততক্ষণে বুঝে গেছে, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তখন ওরা বায়না ধরে, আমাদের কাছে থাকা গ্রেনেড তাদের দেখাতে হবে। ভয় তখনো কাটেনি। তবু রাজি হই আমরা। তবে বলি, গ্রামের বাইরে গিয়ে গ্রেনেড দেখাবো। তাদের সঙ্গে নিয়েই শোলার আঁটিটি মাথায় করে বের হই আমরা। গ্রামের সীমানার বাইরে এসে কোঁচড় থেকে গ্রেনেড বের করে গ্রামবাসীকে দেখাই। রওনা হই জাঙ্গালিয়াগাঁতি ভদ্রঘাটের দিকে।

 

 

অনুলিখন : সাইফুল ইসলাম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads