• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার শিক্ষাভাবনা

  • প্রকাশিত ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

ড. মো. হাসান খান

 

 

আমাদের মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি না জন্মালে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, আমরা পেতাম না লাল-সবুজের পতাকা। পরাধীন জাতি হিসেবে নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করতাম। বঙ্গবন্ধু জন্মেছেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের স্বাধীনতা, অধিকার আদায়ের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর জীবনের সঙ্গে মিশে আছে।

স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে সুখী-সমৃদ্ধ ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তিনি চেয়েছেন বাংলাদেশ হবে সোনার বাংলা, বাংলার মানুষ হবে সোনার মানুষ। তিনি কাজ শুরু করেছিলেন, কিন্তু সমাপ্ত করতে পারেননি স্বাধীনতাবিরোধীদের জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধীরা তাকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। সোনার বাংলার স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে দেশ চলে পাকিস্তানি কায়দায়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মুছে ফেলার চেষ্টা হয়। আজ ২০২১ সালে সেসব অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী কর্মকাণ্ডের কথা কল্পনাও করা যায় না। কারণ এখন বাংলাদেশ আমাদের আশা-ভরসার স্থল বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে রয়েছে। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করতে কাজ করছেন দুর্বার গতিতে। তিনি আছেন বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। জাতির পিতা সোনার মানুষ বলতে আলোকিত, সুশিক্ষিত, দেশপ্রেমী মানুষকে বুঝিয়েছেন। কারণ এমন মানুষ না হলে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়া অসম্ভব। তিনি বলেছেন, শিখলেই শিক্ষিত হয় না, সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্ত হতে হবে। বঙ্গবন্ধু সবসময় সুশিক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। সুশিক্ষা ছাড়া সোনার মানুষ কল্পনা করা যায় না। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে একটি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চাইতে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছু হতে পারে না।... নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। পাঁচ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষাদানের জন্য একটা ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ চালু করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার দ্বার সব শ্রেণির জন্য খোলা রাখতে হবে। দ্রুত মেডিকেল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দারিদ্র্য যাতে উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবী ছাত্রদের অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।” এই হলো বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাভাবনা, তার কথাগুলো আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক।

স্বাধীনতার পর থেকে তিনি বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে বহু কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। তার আমলে প্রণীত ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বলা হয়েছে : (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য; (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য; (গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ বঙ্গবন্ধু এই লক্ষ্য পূরণে সর্বদা কাজ করেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে জাতির পিতা ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার কয়েক লাখ শিক্ষককে সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা দান করেছে। বঙ্গবন্ধু আইয়ুব খানের ১৯৬২ সালের শিক্ষা বিষয়ক কালো আইন বাতিল করেন। এছাড়া তিনি ১৯৭২ সালে ড. খুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। (সূত্র : বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনা ও শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন, ড. হারুন-অর-রশিদ, উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)

বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব হয়েছে। তিনি ২০১০ সালে আমাদের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ উপহার দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২০ সালে দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ৭৪.৭ শতাংশ। ২০০৫ সালে বিএনপি সরকারের সময় এ হার ছিল ৫৩.৫০ শতাংশ। সাক্ষরতা বিস্তারের জন্য শেখ হাসিনা সরকার ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা পুরস্কার লাভ করেন। প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করা হয়েছে। বই উৎসব শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি সাফল্য। স্কুলে উপবৃত্তি, মিড ডে মিল, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তকসহ নানা ধরনের সুবিধা প্রদান করায় দেশে প্রতি বছর ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হার কমছে। বিশেষ শিশু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য সরকার আলাদা উদ্যোগ নিয়েছে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার পরিবর্তন, যুগোপযোগী পাঠ্যবই প্রস্তুত, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংযুক্তকরণ, কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণ, মাদরাসা শিক্ষা আধুনিকায়ন, আইসিটি শিক্ষা নিশ্চিত করেছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। তাই বদলে গেছে সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। সকল স্তরের পরীক্ষার ফলাফলও সন্তোষজনক।

বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে এই যে সাফল্য তা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণে। তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করে সুশিক্ষিত নাগরিক তৈরিতে কাজ করছেন। তিনি এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘সুশিক্ষায় সুশিক্ষিত হওয়া ছাড়া কোনো জাতি উন্নত হতে পারে না। সেটা অনুধাবন করেই আমরা আমাদের শিশুদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কাজ করছি।’

বিগত দুই বছর জননেত্রী শেখ হাসিনা যার কাঁধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি চাঁদপুরের অহংকার, মাটি ও মানুষের নেত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। তিনি শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে সুশিক্ষা নিশ্চিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন সাফল্যের সঙ্গে। তার নেতৃত্বে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ডা. দীপু মনি ইতোমধ্যেই সফল শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য সফলতার একটি হলো, ২ হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা। গত ১০ বছর এই এমপিওভুক্তি কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তার আরেকটি সাফল্য হলো প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা। এতদিন নানাভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সফলতা আসেনি। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার ওপর জোর দিয়ে এ বছর থেকে মাধ্যমিকের সব ক্লাসে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছেন। এই উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। শিক্ষাক্ষেত্রে জনবল নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ, গ্রেডিং সিস্টেম সমন্বয়, পাঠ্যপুস্তক সময়োপযোগী করাসহ উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। তাই মন্ত্রীদের মধ্যে তার সুনাম সর্বত্র রয়েছে।

করোনাকালে সারা বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর দূরদর্শিতায় শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় করোনাকালে যথাসময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, আমি শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না। পরিস্থিতি অনুকূলে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বিকল্প উপায়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিশেষ সংসদ টিভি ও অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতে করোনাকালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অব্যাহত ছিল। শিক্ষাসংক্রান্ত ক্ষতি অনেকটা কাটানো গেছে। আজ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ফল প্রকাশিত হয়েছে। করোনার কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষার আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। তাই বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেওয়া হয়েছে। জেএসসি ও এসএসসির ফলাফল মূল্যায়ন করে এইচএসসির ফল প্রকাশ হয়। এতে করে করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের একবছর সময় নষ্ট হলো না।

বঙ্গবন্ধু সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি চেয়েছেন মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ হোক, সবার মুখে হাসি ফুটুক, বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে উজ্জ্বল হোক। এজন্য সুশিক্ষার বিকল্প নেই। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাই সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করছেন। আজ পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাঙালি ও বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রে মেধা, জ্ঞান ও গবেষণায় বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়বে-এমনটাই প্রত্যাশা।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads