• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

২০৪১ : উন্নত রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ

  • প্রকাশিত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মনোয়ার হোসেন

 

 

স্বাধীনতা অর্জনের পর নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অনেকেই এবং বিদেশি রাষ্ট্রেরও বহু বিশিষ্টজন চরমভাবে সন্দিহান ছিলেন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তাদের মধ্যে এ ধারণাই বদ্ধমূল ছিল যে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ  অন্ধকার। বাংলাদেশ সার্বভৌম দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি না— এ নিয়েও সন্দিহান ছিলেন কেউ কেউ। দেশের অভ্যন্তরেও অনেকেই বলতেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে অন্য দেশের সহায়তার ওপর নির্ভর করেই টিকে থাকতে হবে। বস্তুত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের জন্য ওই সময় প্রচুর পরিমাণে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। বহু রাষ্ট্র স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আর্থিক ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও রসদ সহায়তা দিয়েছিলেন। তবে এদের মধ্যে কয়েকজন তৎকালীন বাংলাদেশকে নিয়ে কটূক্তি বা বিরূপ মন্তব্য করতে ছাড়েননি। তাদের অনেকেই প্রশ্ন রাখতেন- বাংলাদেশকে কতকাল সাহায্য দিয়ে যেতে হবে! তাদের অবশ্য একটি সাধারণ বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশকে তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

এটা সত্যি যে- অর্থনীতি, অবকাঠামো পুনর্গঠন ও বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক সাহায্য-সহায়তার প্রয়োজন ছিল। যে কারণে পরবর্তী সময়ে বহুজাতিক সাহায্য বা সহযোগিতা সংস্থা, যারা উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসে, বাংলাদেশের জন্য গঠিত ‘ক্লাব’-এর মাধ্যমে ঋণ, সহযোগিতা প্রদান শুরু করে। কোনো কোনো সরকার ‘গ্রান্ট’-এর মাধ্যমে সাহায্য করতে থাকে। সম্পূর্ণভাবে না হলেও বাংলাদেশ ও এর সরকারগুলোর নির্ভরতা বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বেড়ে যায়। এ অবস্থা চলে দীর্ঘদিন- দুই দশকেরও বেশি। তখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার কোনো উদ্যোগ বা স্বপ্ন কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের ছিল কি না, তা সুস্পস্টভাবে বুঝতে পারা যায়নি। বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত এবং লক্ষ্য স্থির করে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে কীভাবে পরিচালনা করা দরকার, সেরকম কোনো ‘ভিশন’ লক্ষ করা যায়নি।

‘বাংলাদেশের সম্ভাবনা প্রচুর’— এ কথা ১৯৯০-এর পর থেকে দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হতে থাকে। এই আশা-উদ্দীপক কথার মূলে ছিল ১৯৮৫-এর পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি ও আয়বৃদ্ধির পরিসংখ্যান। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পায় ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রচুর মিল-কলকারখানা গড়ে ওঠে এবং উঠতে থাকে। বৈদেশিক আয়-ব্যয়ের হিসাবে ভারসাম্য আসতে থাকে। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের স্ফীতি (রিজার্ভ) বাড়তে থাকে। ফলে যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি অনেক বেড়ে যায়। বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের একটি অবস্থান তৈরি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে উন্নতি অর্থাৎ দেশাভ্যন্তরে জনগণের সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পরিচয় অর্জনের চেষ্টায় কোনো ‘ভিশন’ তুলে ধরা হয়নি। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবেই বাংলাদেশের পরিচিতি থেকে যায়।

বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি থেকে বের করে আনার জন্য যে ‘ভিশন’, তা প্রথম লক্ষ করা যায় ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে। বাংলাদেশের সব সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে দেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার রূপরেখার কথা তখন প্রকাশ পায়। ২০০৮-এ নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ‘ভিশন ২১’ প্রকাশ করা হয়। লক্ষ্য ছিল, ২০২১-এর মধ্য স্বল্পোন্নত অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে মধ্যমআয়ের দেশে পরিণত করা। এ লক্ষ্য অর্জনে পরিকল্পনা গ্রহণ ও সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭-এর মাঝামাঝি প্রয়োজনীয় লক্ষ্যসমূহ (সূচক) অর্জন করে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের সীমানার কাছে পৌঁছে যায়।

এর পরবর্তী স্তর উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণের জন্য রয়েছে ‘ভিশন ২০৪১’। এই লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলছে। সাফল্যজনকভাবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে উন্নত দেশের পথে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়ে যাবে। তবে মধ্যমআয়ের দেশের কাতারে প্রবেশের মতো উন্নত দেশের কাতারে প্রবেশ করাটা সহজ হবে না। জাতিসংঘ নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন না করে উন্নত দেশের সোপানে প্রবেশ করা যাবে না। উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজন হবে শিল্প-অবকাঠামো, অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে ব্যাপক উন্নয়ন। এজন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ ছাড়াও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আগামী ১২ বছরে অতিরিক্ত ৯২৮.৪৮ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থান অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক, উভয় সূত্র থেকেই করতে হবে। অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সম্পদ আহরণ (রাজস্ব) বর্তমান পর্যায় থেকে বহুগুণ বাড়াতে হবে। যে কারণে দেশে, বিশেষ করে, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সরকারের সার্বিক সক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে এবং প্রকল্পের মান উন্নত করতে হবে।

পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সরকারের বিচক্ষণতার ও দূরদৃষ্টির ওপর। সেই সঙ্গে উন্নয়ন পরিকল্পনায় ধারাবাহিকতা রক্ষা করা একটি  অবশ্যকরণীয় বিষয় হয়ে থাকতে হবে।

বহির্বিশ্বে ‘ইমেজ’ উন্নীতকরণ একটি বড় বিষয়— কারণ তা উন্নয়ন সহযোগীর আস্থা বাড়ায়। এ কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের গণ্ডি থেকে বের করে আনার সুনাম অর্জন করেছে। উন্নত দেশে পরিণত করার জন্য আগামী সরকার/সরকারগুলোকে বহু প্রতিবন্ধকতা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সন্দেহ নেই। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে ২০৪১-এর মধ্যে উন্নত দেশের পরিমণ্ডলে নিয়ে যেতে পারলেই সম্ভব হবে সেই সরকারের চরম সার্থকতা। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads