• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

চিড়িয়াখানায় মাংসাশী প্রাণীর খাবার জীবিত যাবে না মৃত?

  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আর এস মাহমুদ হাসান

 

 


মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় অজগরের খাঁচার গ্রিল ধরে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি খরগোশের ছবি ও ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। জীবিত খরগোশটিকে খাঁচায় রাখা হয়েছে অজগরের খাবার হিসেবে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। প্রশ্ন উঠেছে চিড়িয়াখানার মতো পরিবেশে মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে জীবন্ত প্রাণী দেওয়া কতটা যৌক্তিক? 


আমরা খাদ্যশৃংখলের দিকে তাকালে দেখতে পায় বাঘ, সিংহ, নেকড়ে, হায়েনা, শিয়াল, অজগরসহ সকল মাংসাশী প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন্ত প্রাণীদের শিকার করেই খায়। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী খাবার ও জীবনধারণের জন্য একে অপরের উপর নির্ভরশীল, পরিপূরক। তৃণভোজি প্রাণী গরু, ছাগল, হরিণ প্রভৃতি তৃণলতা খেয়ে জীবন ধারন করে। এসব তৃণভোজি থেকে কিছু প্রাণীকে শিকারী প্রাণীরা (প্রিডেটর এনিম্যাল) তাদের প্রধান খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে জীবনধারণ করে। সাপকে আবার চিল বা শকুন শিকার ধরে খায়।


মাংসাশী প্রাণীরা বন্য পরিবেশে নিজে শিকার ধরে খেয়ে অভ্যস্ত। এজন্য তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চিড়িয়াখানাতে জীবিত প্রাণী দেয়া হয়। তবে চিড়িয়াখানায় অধিকাংশ সময় মাংসাশী প্রাণীকে জবাই করা গবাদিপশুর মাংস দেওয়ার কারণে অল্প পরিশ্রমে আহারের ব্যাবস্থা হওয়ায় প্রাণীগুলো দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়ে। জীবিত প্রাণী দেওয়ার ফলে মাংসাশী প্রাণী কিছুটা হলেও নিজস্ব পরিবেশ ও কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পাই। বিশ্বের অধিকাংশ চিড়িয়াখানাতে এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, কারণ হিসাবে ভেটেরিনারিয়ান চিকিৎসকেরা দাবি করেন শিকার ধরে খেলে অজগরের প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া জীবন্ত প্রাণী না দিলে অজগর তার প্রিডেটরি আচরণ ভুলে যায় যা তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।


যদিও প্রাণীপ্রেমীরা দাবি করেন বন্যপ্রাণীরা শিকার ধরে খেয়ে অভ্যস্ত হলেও চিড়িয়াখানার পরিবেশে এ পদ্ধতি অমানবিক। তাদের কথা বিবেচনায় রেখে মাংসাশী প্রাণীকে খরগোশসহ অন্য যেকোনো প্রাণী খেতে দিতে হলে প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে খাদ্যে পরিণত হওয়া প্রাণীটিকে সহজভাবে হত্যা করে তাজা খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে খাবার হিসেবে সরবরাহের পূর্ব পর্যন্ত ওই প্রাণীর খাদ্য, চিকিৎসাসহ তার প্রাপ্য সব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর জীবন্ত প্রাণি যদি দিতেই হয় তবে তার কষ্ট লাঘব করতে হবে।


সাপ সাধারণত জীবিত প্রাণীই খেয়ে থাকে। জীবন্ত প্রাণী খেতে দেখলে দর্শনার্থীদের বিশেষকরে শিশুদের মনে বিরুপ প্রভাব তৈরি হতে পারে, এজন্য বিকল্প পদ্ধতি হিসাবে অজগর বা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীকে রাতে জীবন্ত প্রাণী দেওয়া যেতে পারে। উন্নত কিছু দেশে অজগর সহ অন্যান্য সাপকে খাওয়ানোর সময় লম্বা লাঠির মাথায় মৃত প্রাণী বা মাংস রেখে নাড়ানো হয় যাতে সাপ খাবারটিকে জীবন্ত মনে করে। তবে এজন্য চিড়িয়াখানার কর্মীদের আগে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, সাথে মাংসাশী প্রাণীকেও অভ্যস্ত করাতে হবে।


একজন মানুষের যেমন অধিকার আছে, তেমনই প্রত্যেক প্রাণীরও অধিকার আছে। চিড়িয়াখানার প্রাণীকে জীবন্ত খাদ্য দেয়া যাবে কিনা তার ইঙ্গিত প্রতিটা দেশের প্রাণীকল্যাণ আইনে দেয়া থাকে। আর তাই ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রণীত হয়েছে প্রাণীকল্যাণ আইন। বাংলাদেশের প্রাণী কল্যাণ আইনে জীবন্ত প্রাণী খাদ্য হিসাবে দেয়া যাবেনা এই মর্মে কোন ধারা, উপধারা সংযোজন করা হয়নি বরং চিড়িয়াখানা পরিচালনার স্বার্থে ক্ষেত্র বিশেষ নিষ্ঠুরতাকে শিথিল করা হয়েছে।


বাংলাদেশ সরকারের প্রাণীকল্যাণ আইন ২০১৯ এর ০৬(১) ধারায় প্রাণীকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো, মারধর করা, প্রয়োজনীয় খাবার না দেয়া, খেতে না চাইলেও জোরপূর্বক খাওয়ানো, অপ্রয়োজনীয় প্রহার, অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো, বসবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে দেয়া, বিরক্ত করা, ক্ষতিকর ওষুধ দেয়া, অসুস্থ অবস্থায় বা মৃত্যু ঘটানোর জন্য কোনো প্রাণীকে লোকালয়ে ছেড়ে দেওয়া, প্রাণী দিয়ে লড়াই করানো, রাইফেল শুটিং বা তীর ছোড়া প্রতিযোগীতায় প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে ব্যবহার করা, আহত প্রাণীর চিকিৎসা না করা, অনুমোদন ছাড়া বিনোদনের স্বার্থে ব্যবহার করা প্রভৃতি প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।


একই আইনের ০৬(৪) ধারায় বর্ণিত নিষ্ঠুরতাসমূহ যদি  নিজ নিজ ধর্ম কর্তৃক স্বীকৃত আচারানুষ্ঠানের জন্য করা হয়, কোন স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে করা হয় অথবা চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনার জন্য প্রচলিত আইন, বিধি বা নীতিমালার আলোকে চিড়িয়াখানায় রক্ষিত প্রাণীর ক্ষেত্রে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় তা এই আইনের আওতায় অপরাধ বলে গণ্য হবে না। 


আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের Prevention of Cruelty to Animal Act 1962 (Ammended in 1982) এর ১১ ধারায় যে নিষ্ঠুরতাগুলি উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে প্রাণীকে জীবন্তু খাদ্য সরবরাহের  কথা উল্লেখ নেই। আফ্রিকা, চায়নাতেও জীবন্ত প্রাণী খাদ্য হিসাবে সরবররাহ করতে আইনগত কোন বাঁধা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন The Veterinary Surgeons Act and The Humane Method of Slaughter Act এ স্পষ্ট করা হয়েছে প্রাণীকে জবাই করার পূর্বে অবশ্যই অজ্ঞান করতে হবে। তাই তারা মাংসাশী প্রাণীকে জীবন্ত প্রাণী দেয়ার ক্ষেত্রে অজ্ঞান বা সদ্য মৃত প্রাণী সরবারহ করে থাকে। কিন্তু জীবন্ত প্রাণী দেয়া যাবেনা এমন কোন কথা আইনে উল্লেখ নেই।


ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ইউকে, অস্ট্রেলিয়াতে এ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার এক্ট এবং জু লাইসেন্সিং এক্ট এর আওতায় জীবন্ত প্রাণী সরবরাহ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে বলা হয়েছে একমাত্র ভেটেরিনারি সার্জন যদি এডভাইস করে তখন জীবন্ত প্রাণী দেয়া যাবে। প্রিডেটর না খেলে ৬ ঘন্টা পর প্রাণী কে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হইছে ব্রিটেনের আইনে। তবে শুধুমাত্র কুইন্সল্যান্ডের আইনে (এ্যানিমেল কেয়ার এন্ড প্রটেকশন এক্ট) সরাসরি জীবন্ত খাদ্য দিতে নিষেধ আছে।


প্রিডেটরের খাবার জীবন্ত যাবে না মৃত যাবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য নির্দিষ্ট কোন আইন বা আইনি কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ভেটেরিনারি সার্জন যদি জীবন্ত প্রাণী দেবার এডভাইস করে তবে জীবন্ত প্রাণী দেয়া যাবে তা নাহলে নিরুৎসাহিত করতে হবে। প্রিডেটর জোনের সামনে ছবি উঠানো নিষেধ, এটা সঠিকভাবে কার্যকর করতে হবে। কারণ যেখানে ছবি তোলা নিষেধ সেটা মেনে চলার বিধান নিশ্চিত করা প্রাণীকল্যাণের অংশ। আমাদেরকে প্রাণীর ফিজিওলজি-ইকোলজি সম্পর্কে ভালোভাবে ধারনা রাখতে হবে। মাংসাশী প্রাণীর অভ্যাস বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কোন প্রাণীর পক্ষে অতিরিক্ত পক্ষপাত দেখিয়ে অন্য প্রাণীকে অভুক্ত রাখার অধিকার আমাদের নেই। কারো পক্ষপাত না করে, সকল প্রকার প্রাণীর অধিকার যেন নিশ্চিত হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

 


লেখকঃ আর এস মাহমুদ হাসান
শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি মেডিসিন বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি, গোপালগঞ্জ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads