• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মালুদা থেকে শতরঞ্জি

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০ বছর। এই প্রৌঢ়ত্বে এসে অর্থনৈতিকভাবে দেশ এখন অনেক ক্ষেত্রেই স্বয়ম্ভু। আর এ ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক সাফল্যকে খাটো করে দেখার কিছু নেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের বস্ত্রশিল্পের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশকে বস্ত্রায়ন শিল্পের জন্মভূমি বলা হয়ে থাকে। স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলাদেশ কারুশিল্পের জন্য গর্ববোধ করে আসছে। গ্রামের শিল্পী ও কারিগররা প্রাকৃতিক পরিবেশজাত উৎপাদন দিয়ে কারুশিল্প সামগ্রী সৃষ্টি করে থাকেন। উত্তর জনপদের প্রাচীনতম রংপুর জেলার তাঁতিরা এক ধরনের মোটা কাপড় তৈরি করে যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি শব্দটি শতরঞ্জ শব্দ থেকে এসেছে। এটি ফার্সি ভাষার শব্দ। দাবা খেলার ছককে শতরঞ্জ বলা হয় এবং দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকার কারণে এটাকে শতরঞ্জি নামে নামকরণ করা হয়।  রং-বেরঙের সুতা আর প্রকৃতিনির্ভর গ্রামীণ নকশায় কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতের অনবদ্য সৃষ্টি শতরঞ্জি। দেশি প্রযুক্তিতে বাঁশের অতি সাধারণ যন্ত্র বা তাঁত ব্যবহূত হয় শতরঞ্জি উৎপাদনে। শতরঞ্জি মূলত এক প্রকার কার্পেট। এক সময়ে সমাজের অভিজাত শ্রেণির গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহূত হতো। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মোগল সম্রাট আকবরের আমলে বাংলাদেশে শতরঞ্জি শিল্পের প্রথম প্রসার ঘটে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এক সময় শুধু বাঁশের তৈরি তাঁতযন্ত্রে মোটা সুতি কাপড় ও উলেন সুতা ব্যবহার করে পাটিজাতীয় পণ্য তৈরি হতো। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ছিল ‘মালুদা’। এসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে নিয়োজিত কারুশিল্পীরা বিভিন্ন নকশার মধ্য দিয়ে গ্রামীণ প্রকৃতিকে শিল্পকর্মে ফুটিয়ে তুলতেন। দৃষ্টিনন্দন এসব পণ্য ক্রমেই দেশ-বিদেশের মানুষকে আকর্ষণ করে। সেই মালুদাই পরবর্তী সময়ে শতরঞ্জি নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।

এই পুরোনো ঐতিহ্য নিয়ে আবারো আশার আলোয় জেগে উঠেছে রংপুরের ‘শতরঞ্জি শিল্প’। সেকালের শতরঞ্জি পরিবর্তনের ধারায় মানুষের রুচিবোধ আর চাহিদার আলোকে বাঙালির শিল্পকর্মে এসেছে পরিবর্তনের ছাপ। শতরঞ্জি ব্যবহারের পরিধি বাড়ছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে সমাদৃত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। শৌখিন পণ্য হিসেবে অনেকটা নতুনত্বকে ধারণ করে বিচিত্রময় কারুকাজে তৈরি হচ্ছে শতরঞ্জি। বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওয়ালম্যাট, টেবিলম্যাট, ফ্লোরম্যাট, কুশনকভার, সোফার রুমাল, জায়নামাজ, পাপোশ, ক্যাপ ও বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ ইত্যাদি। ওয়ালম্যাট তৈরিতে অনেক নকশার মধ্যে থাকছে গাঁয়ের বধূ, পুতুল, নৌকা, গরুর গাড়ি এবং গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন দৃশ্যপট। গ্রামীণ বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য নকশাখচিত শতরঞ্জিতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এক সময়ে এখানকার শতরঞ্জি শিল্প ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। বর্তমানে দেশ-বিদেশে ক্রমেই বাড়ছে এসব পণ্যের চাহিদা। প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই শতরঞ্জি শিল্প এখন রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ৩৬টি দেশে। বিভিন্ন উপাত্ত থেকে জানা গেছে, হস্তজাত এ শিল্প থেকে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। কালের আবর্তে বাঙালির অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জিশিল্প স্বকীয়তার মাঝে আজো বিকশিত হচ্ছে। আগে শতরঞ্জি উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল ছিল পাটের সুতলি। কিন্তু বর্তমানে এ পণ্য উৎপাদনে রঙিন কটন সুতা, পাটের সুতা ও উলেন সুতার ব্যবহার হচ্ছে। কাঁচামালের সহজলভ্যতা এ শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। রুচিশীল, নান্দনিক বাহারি পণ্য উৎপাদন, আধুনিক সময়োপযোগী করে তোলা ঐতিহ্যবাহী ডিজাইন আর বাহারি রঙের ব্যবহারে নতুনমাত্রা পেয়েছে শিল্পটি।

তথ্য উপাত্ত থেকে দেখা গেছে, ২০০২ সালে প্রথম জাপানে শতরঞ্জি রপ্তানির করে আয় হয় ২০ হাজার ডলার। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ‘আইকা’ বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন শতরঞ্জি সামগ্রী আমদানি করে তা ইউরোপের চাহিদা পূরণ করেছে। চাহিদা বৃদ্ধির ফলে ‘আইকা’ ছাড়াও বিবি রাসেল ও কারুপণ্যের উদ্যোগে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মাছকুটি গ্রামে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শতরঞ্জি কারখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। রংপুরের নিভৃত পল্লিতে উৎপাদিত শতরঞ্জি সামগ্রী ঢাকার বেশ কয়েকজন রপ্তানিকারকের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। প্রতি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ কারুশিল্প সামগ্রী রপ্তানি হয়, তার ৫০ ভাগই শতরঞ্জি। এটি রপ্তানির মাধ্যমে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর একটি সুইডিশ সংস্থা রংপুরের নিশবেতগঞ্জের কারুশিল্পীদের দিয়ে কিছু শতরঞ্জি উৎপাদন করে নিজ দেশে নিয়ে যায়। ১৯৭৬ সালে প্রথম সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিশবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারিভাবে বিসিক শতরঞ্জি শিল্পে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা প্রদান করে। বিসিকের গ্রামীণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা এবং নকশা কেন্দ্রের মাধ্যমে শতরঞ্জি উৎপাদনে জামদানি নকশা প্রচলনের কর্মকাণ্ড চালানো হয়। এতে এলাকার শতরঞ্জিশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কিন্তু অর্থসংস্থান না থাকায় নব্বইয়ের দশকের পর এসব কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। তবে বিসিকের উদ্যোগে এই শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীসময়ে ঢাকার এক ব্যবসায়ী বিসিকের এই কেন্দ্রটি লিজ নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেন। ১৯৯১ সালে নিশবেতগঞ্জ গ্রামে বিসিকের বন্ধ থাকা একটি দোচালা ছোট্ট কারখানা ভাড়া নিয়ে ঝিমিয়ে পড়া শতরঞ্জিশিল্পকে জাগিয়ে তুলতে উদ্যোগ নেন রংপুরের কারুপণ্যের স্বত্বাধিকারী সফিকুল আলম সেলিম। বলা যায়, কারুপণ্যের মালিক শফিকুল আলম সেলিমের আন্তরিক প্রচেষ্টায় শতরঞ্জির ব্যবহার আরো বহুমুখী হয়ে ওঠে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার মধ্য দিয়ে খ্যাতিসম্পন্ন ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের উদ্যোগে ইউরোপিয়ান কমিশনের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারে রংপুরের শতরঞ্জির পরিচয় ঘটে। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি ও রপ্তানিও হতে থাকে। এভাবে বাড়তে থাকে শতরঞ্জির চাহিদা। পরবর্তীসময়ে কারুপণ্যের উদ্যোগে ঢাকায় ‘শতরঞ্জি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান খোলাসহ রংপুরের রবার্টসনগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও জেলা সদর, কুড়িগ্রাম এবং উলিপুর পৌর এলাকায়ও গড়ে উঠেছে শতরঞ্জি কেন্দ্র।

তথ্যের আলোকে দেখা গেছে, বাংলাদেশে হস্তশিল্প রপ্তানি আয়ের শতকরা ৬০ ভাগের অবদান কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের। অসাধারণ এই কাজের জন্য ২০১০ সালে সরকারি পর্যায়ে জাতীয় রপ্তানি ট্রফির স্বর্ণপদকের পুরস্কার পায় কারুপণ্য। সুতরাং একে আর আবহেলা নয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পার করছি। একই সঙ্গে ২০২১-৪১ রূপকল্পে উন্নত রাষ্ট্রের পথে যাত্রা শুরু। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা জরুরি। আর তাই সম্ভাবনাময় এ শিল্পের উন্নয়নে আমাদের মনোযোগী হতে হবে আরো অধিকমাত্রায়। যদিও বিসিক লক্ষ-কোটি টাকা ব্যয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে রয়েছে কারুশিল্পীদের মধ্যে ঋণসহায়তা প্রদান, উন্নত ও বিচিত্রময় নকশা ও নমুনা বিতরণের মাধ্যমে নতুন নতুন পণ্য উৎপাদনসহ শতরঞ্জিশিল্পের উন্নয়নে প্রশিক্ষণ, উৎপাদন ও প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন।

বর্তমানে এ শিল্পের সম্ভবনা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন আশা। মূলত শিল্প এলাকায় উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধা, কারিগরি জ্ঞান বিকাশে প্রশিক্ষণ, ডিজাইন ও রঙের ব্যবহার নিয়ে গবেষণার আলোকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দ্রুত বিকশিত হবে এ শিল্প। দেশীয় শিল্পের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি বৈদেশিক আয় এবং কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বাংলার শতরঞ্জি শিল্প।

 

লেখক :  উন্নয়ন গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads