• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু

  • প্রকাশিত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সিরাজুল ইসলাম সোহাগ

 

 

 

ঔপনিবেশিক-উত্তর আমলে বাংলাদেশই একমাত্র ভূখণ্ড যেটি নৃতাত্ত্বিক, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ইতোপূর্বে এরূপ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে চেতনাবদ্ধ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার কোনো ভূখণ্ড স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে নিজেদের উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে বেছে নিয়েছিল। তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে শাসন-শোষণের অনুকূল পরিবেশ-প্রতিবেশ জিইয়ে রেখেছিল। কিন্তু ক্রমেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির কাছে বোধগম্য হতে থাকে যে, তারা কী পরিমাণ শাসন-শোষণ, বঞ্চনা, নিষ্পেষণ ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার। ফলে লড়াকু বাঙালিদের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে থাকে, যা শুরু হয়েছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন তথা ভাষাভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি ছিল বাংলা ভাষার ওপর পাকিস্তানি কুচক্রী শাসকদের পুরোপুরি আগ্রাসন। আধুনিক ভাষায় প্রকাশ করলে যাকে বলা যায় ‘সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস’!

তারা ভেবেছিল বাঙালির ভাষার দাবিকে রুখে দিতে পারলেই তাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধের পরিবেশ রোধ করা যাবে। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদের রূপান্তর রোধ করার জন্য নিজেদের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর ছিল। এ কারণে ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তৎকালীন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তার এই ভাষণে তাৎক্ষণিকভাবে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা ‘নো-নো-নো’ ধ্বনি তুলে প্রতিবাদ জানায়। শুরু হয় আন্দোলন এবং এই আন্দোলন একটা পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। বাঙালির সর্বস্তরের মানুষজনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে আন্দোলন এমন প্রকাণ্ড আকার ধারণ করে যে, সরকার সে আন্দোলন দমন করার জন্য গুলি চালাতে বাধ্য হয়। প্রাণ হারায় বেশ কয়েকজন ছাত্র-যুবক। সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউল্লাহ ও বরকতসহ আরো অনেক ভাষাসংগ্রামী প্রাণ হারান। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধরে নিয়েছিল বন্দুকের নলের মুখে রক্তাক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলেই বাঙালির জাতীয়তাবাদের চেতনাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু না, তাদের রক্ত বৃথা যায়নি। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৫৬ সালে। ওই সময়ের গণআন্দোলন শুধু একটা ভাষাভিত্তিক আন্দোলন ছিল না, বরং সেই সময় বাঙালিদের মধ্যে স্বাধিকার তথা স্বায়ত্তশাসনের যে প্রাণের দাবি উঠেছিল, সেই আন্দোলনের পরিপূরক ছিল ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও বিস্তার দেখে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয়তাবাদের বিকাশকে পূর্ণরূপ দেয়ার প্রত্যয় নেন।

আজীবন মাতৃভাষাপ্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে এবং ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয়পর্বে রাজপথে আন্দোলন ও কারাবরণ, পরে আইনসভার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রাম ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অন্যতম ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মোদ্দাকথা রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ইতিহাসের অনন্য দৃষ্টান্ত।

রাজনৈতিক উদ্যোক্তার অনন্য প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে, ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ গঠন করার পরই বাংলা ভাষার দাবিকে গণদাবিতে রূপদান করেন। পাকিস্তান পার্লামেন্টের একজন সদস্য হিসেবে তিনি বারবার স্পিকারকে এই বিষয়ে স্মরণ করিয়ে দেন। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষাকে উপেক্ষা করার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নকেও অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেওয়া যাবে, তারা আর মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু মা, মাটি ও মানুষের জন্য ত্যাগী প্রাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে, এখনই সুউচ্চ সময় বাঙালির অধিকার আদায়ের। তাই তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত ও তেজোদ্দীপ্ত দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে কঠোর অথচ জনসম্পৃক্ত আন্দোলন গড়ে তোলেন।

পাকিস্তান জন্মের সন্ধিক্ষণে, ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু রাজনৈতিক কর্মী একত্রিত হয়েছিলেন কলকাতার ঐতিহাসিক সিরাজ-উদ-দৌলা হোটেলে। উদ্দেশ্য পূর্ব পাকিস্তানের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ তথা একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা। সেই ঐতিহাসিক কর্তব্য নির্ধারণী প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের কর্মী সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক উল্লেখযোগ্য কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রসঙ্গে গাজীউল হক ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন ‘সম্মেলনের কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেছিলেন সেদিনের ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ প্রস্তাবগুলো ছিল— ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ তার এরূপ ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়েছিল মূলত সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রাণের দাবি। এভাবেই তিনি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠায় সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে বাঙালির হূদয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন।

বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে যখন ছাত্র-যুবাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে রাজপথ প্রকম্পিত তখন বঙ্গবন্ধু কারা অন্তরীণ ছিলেন। কিন্তু বন্দি থাকা সত্ত্বেও অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু তার মা, মাটি ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে হাজার বাধা-বিপত্তি ও ঝুঁকিকে উপেক্ষা করে ছাত্রদের দিকনির্দেশনা দিতেন।

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের স্বাধিকারের স্বপ্নই ক্ষণে ক্ষণে বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহী করে তোলে। সেই উৎসাহ নতুনরূপে ফিরে আসে ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এখানেই শেখ মুজিবের বড় কৃতিত্ব। তিনি বাঙালির বাঁচার দাবিকে স্পষ্টভাবে ব্যাখা করেন। ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রধান শত্রুরূপে পরিচিত হয়ে ওঠেন। স্বৈরাচার আইয়ুব খান এহেন পরিস্থিতিতে অস্ত্রের ভাষায় বাঙালির বাঁচার দাবিকে দাবিয়ে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। কিন্তু তেজোদীপ্ত বঙ্গবন্ধু কুচক্রীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ৬-দফার মূল বাণীকে বাঙালির মুক্তির বার্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। জনগণের অভূতপূর্ব ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। তারপরেই তিনি সামরিক জান্তা দ্বারা পরিচালিত সরকারকে গণতান্ত্রিক নির্বাচন দিতে বাধ্য করেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জনগণের অভূতপূর্ব সাড়ার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই নির্বাচনের ফলই ইঙ্গিত বহন করে বঙ্গবন্ধু আপামর সাত কোটি বাঙালির প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছেন। গণতান্ত্রিক উপায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে শাসিত হতে হবে এমন ভয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের বৈঠক অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেন। প্রতি-উত্তরে বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বাঙালির হার না মানা মনোবলের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলনে মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে কেন্দ্রীয় সরকার অচল হয়ে পড়ে।

বাঙালির আপামর জনসাধারণ বঙ্গবন্ধুকে তাদের প্রতিনিধি বিবেচনা করে শাসক হিসেবে বেছে নেন। এসব কিছুর অন্তরালে ইয়াহিয়া-ভুট্টো জোট নিজ দেশের জনতার বৈধ দাবিকে চিরতরে রোধ করার প্রয়াসে ছক কষতে থাকেন। চলে আসে ২৫ মার্চ কালো রাত। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির নেতৃত্বে শুরু হয় বাঙালি নিধনের মহাযজ্ঞ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হয়তো ভুলে গিয়েছিল যে, জনসাধারণের নায্য দাবিকে পৃথিবীর কোনো শক্তিশালী সেনাবাহিনীর ট্যাংক, কামানের মুখেও নিস্তব্ধ করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার সোনালি সূর্য ছিনিয়ে এনেছে। প্রতিষ্ঠা করছে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের।

আমরা বাঙালি জাতি আজ বলার, লেখার বাহন হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। ভাষার এরূপ কাঠামো নির্ধারণে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয় ও চিরভাস্বর। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার আত্মত্যাগ, অবদান আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকবে। তিনি তার আদর্শের মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, ছিলেন এবং থাকবেন। যাদের আত্মত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে আমরা আজ বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি, ভাষার এই মাসে সেসব শহীদ বীর সেনানীর প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

লেখক : গবেষক ও নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads