• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের নারী

সামাজিক অগ্রগতির সূচকে নারীর ক্ষমতায়ন

  • প্রকাশিত ০৫ মার্চ ২০২১

শাহীন চৌধুরী ডলি

 

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে নারী-পুরুষ উভয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা রেখেছেন। এরও আগে ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন এবং মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও নারীর ছিল গৌরবোজ্জ্বল অংশগ্রহণ। স্বাধীন দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতেও বাংলাদেশের নারীসমাজ বৈষম্যমুক্ত কোনো দেশ পায়নি। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারী পিছিয়ে থাকলে দেশ এগিয়ে যেতে পারবে না। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২০১১ সালে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা’ প্রণয়ন করেন। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ১৯৭৯ সালে সিডও কনভেনশনে Conversation on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CEDAW) স্বাক্ষর করা প্রথম দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি গত ৫০ বছরে দেশের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে। সামাজিক অগ্রগতির সূচকে নারীর ক্ষমতায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সমাজের সব স্তরে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় নারী আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশি দৃশ্যমান। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের শতভাগ উপস্থিতি। কিন্তু বিশেষভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায়ে পাঠ-সমাপনের বিষয়টা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই পর্যায়ে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি। দরিদ্রতার কারণে পরিবার থেকে মেয়েদের পড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে বখাটেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। যার কারণে অনেক মেয়েদের পড়া বন্ধ করে বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়। সমাজে বাল্যবিবাহের আরো কারণ তো আছেই। শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে সরকার শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ করছেন। নারীশিক্ষাকে এগিয়ে নিতে মাধ্যমিক পর্যন্ত উপবৃত্তি চালু করেছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমঅধিকারের কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি ইউনিফরম ফ্যামিলি কোড স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাস্তবতায় করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার উদ্বেগজনক। তবে দিন দিন মানুষের মধ্যে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সচেতনতা গড়ে উঠছে। বাল্যবিবাহ রোধে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তারপরেও অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের মেয়েদের শহরে নিয়ে গোপনে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে নারীরা সুরক্ষা পাচ্ছে না। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। নারীরা তালাক প্রদানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সম্পদের অধিকার নেই। সম্পদের উত্তরাধিকারে নারীদের সমান অধিকার নেই। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারীর সম্পত্তির প্রতি সমঅধিকার অর্জিত হয়নি। মুসলিম হেবা আইনের মতো হিন্দু পরিবারেও নারীদের সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারের ব্যবস্থা সরকার করেছেন। যতটুকু অধিকার আছে তাও নারীরা অর্জন করতে পারছেন না।

বাংলাদেশের গ্রাম-শহর সর্বত্রই ঘরে-বাইরে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পিতামাতার ভরণপোষণ বিশেষ করে বৃদ্ধা মাকে অনেকে অবহেলা করে। এটি যাতে না করতে পারে এজন্য সরকার আইন পাশ করেছে, শাস্তির বিধান রেখেছে। কিন্তু বিভিন্ন আইন থাকা সত্ত্বেও প্রায় ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ৬৫ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়া মজুরি বৈষম্য, নিরাপদ মাতৃত্বের অধিকার ও কর্মস্থলে নিরাপত্তা না থাকা, নারীর প্রতি বৈষম্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। নারীরা যতই শিক্ষায় বা কর্মক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠুক না কেন, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব যদি তাদের সর্বদা ভাবিয়ে তোলে তবে নারীদের পক্ষে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সর্বস্তরে তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। শিশু পালনে মায়ের পাশাপাশি পিতারও ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি পিতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা চালু করা হোক।

বছরের পর বছরজুড়ে বিশ্বের নানা সমাজে পুরুষের আধিপত্য দেখা গেছে। বাংলাদেশেও সামাজিক রীতিনীতি এমনভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যে, নারীর জন্য সমাজের কিছু এলাকা যেন নিষিদ্ধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাজের নেতাদের অধিকাংশ এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ধর্মীয় অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে নারীকে পিছিয়ে রাখা হয়। অথচ ধর্মে নারীকে সম্মানিত করা হয়েছে। নারীকে প্রতিবাদী হতে হবে। প্রতিবাদ করতে না শিখলে পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে কোনো নারী যদি কোনো সিদ্ধান্ত প্রদান করেন, অনেক সময় দেখা যায়, সেটা গ্রহণ করতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করেন। এমনকি অন্য নারীরাও সেটি সহজে গ্রহণ করতে চান না। এ ধরনের মনোভাব নারীর মতামত ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী।

প্রতিবছর বিশ্ব নারী দিবস বাংলাদেশেও পালন করা হয়। প্রতিবছর একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়। গত বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘প্রজন্ম হোক সমতার : সকল নারীর অধিকার’। বিগত ২৫ বছর ধরে অনেক আকর্ষণীয় প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে এর কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি। বরাবরের মতোই নারী থেকে গেছে অবহেলিত, অধিকারবঞ্চিত। পুরুষের ক্রিয়াশীল মনন নারীকে কেবল বাঁচিয়ে রাখে, প্রাপ্য অধিকার দেয় না। একদিকে সমাজে নারীরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অন্যদিকে সাংঘাতিকভাবে হচ্ছে মানসিক নির্যাতনের শিকার। পদে পদে নারীকে অপমান সইতে হয়। অথচ এটাই সত্যি যে ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারী নিজের শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য অর্থনীতিতে মজুরির ঊর্ধ্বচাপ কমাতে নারীকে শ্রমবাজারে আনা পুরুষতান্ত্রিক কৌশল। নারীকর্মীর মজুরির ওপর মালিকপক্ষের বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। নারীর প্রকৃত অধিকারকে আড়াল করে পুঁজিবাদ বাণিজ্যিক স্বার্থে নারীকে পণ্য বানাতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। বাংলাদেশে চাকরিক্ষেত্রে নারী সমসুযোগ থেকে বঞ্চিত। নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের মধ্যে নারী, পুরুষের চেয়ে কম মজুরি পান। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন চেষ্টা খুব ফলপ্রসূ হচ্ছে না। জাতীয় রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ আশানুরূপ বাড়েনি। নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নারীর গুরুত্ব বাড়ছে না। অথচ শিক্ষার সকল ক্ষেত্রেই মেয়েরা ছেলেদের সমান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি মেধার পরিচয় দিচ্ছেন।

উন্নত দেশ কিংবা উন্নয়নশীল দেশ নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ থেকে নারীদের রেহাই নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি লাখে ২৭ জন, যুক্তরাজ্যে ২৯ জন, বাংলাদেশে ৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। বিশ্বে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারীকে সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে। ধর্ষণে নারীর দোষ না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানসিকতায় ধর্ষিত নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল না হয়ে বরং অনেকটা ঘৃণার চোখে দেখা হয়। ফলে অনেকক্ষেত্রে নারী অবমাননার শিকার হয়েও তা প্রকাশে বিরত থাকেন। আইনি সহায়তার ক্ষেত্রেও রয়েছে অবহেলা। নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর মর্যাদাকে হেয় করে। নারী নিজেকে ছোট ভাবতে থাকেন এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশে  সমাজে নারীর অবস্থান উন্নত দেশের তুলনায় অনেকখানি পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপের তথ্য হলো, দেশের ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী আপন গৃহেই নির্যাতনের শিকার। ৬৫ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতন, ৩৬ শতাংশ যৌন নির্যাতন, ৮২ শতাংশ মানসিক এবং ৫৩ শতাংশ স্বামীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন।

নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, সাইবার বুলিংসহ নানারকম সহিংসতা দমনে রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার পাল্লা দিন দিন আরো ভারী হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে ও কর্মক্ষেত্রেই শুধু নয় নিজগৃহেও নারী ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় ভুগছে। অথচ সামাজিক সূচকে বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর রয়েছে বিরাট ভূমিকা। লিঙ্গসমতা সূচকে বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান এখন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নারীদের তুলনায় উন্নত হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশে নারীর অগ্রযাত্রা দৃশ্যমান ও উল্লেখযোগ্য। জীবনমানের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে নারীর জীবনাচারে, যা অত্যন্ত ইতিবাচক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে নারীর শিক্ষাক্ষেত্রে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই প্রশংসনীয়। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার আজ শতভাগের কাছাকাছি। মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নয়ন হচ্ছে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার কমেছে।

দেশের অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব শ্রমবাজারে নারীকর্মীর চাহিদা বেড়েছে। বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব আমাদের দেশের নারীদের। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকের শতকরা ৮০ ভাগ নারী। করোনা পূর্ববর্তী সময়েও প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার নারী অভিবাসী দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, হোটেল-রেস্তোরাঁ, পরিবহন শিল্প, টেলিযোগাযোগ, আবাসন শিল্প, ব্যাংকিং ও বীমা খাত, বৃহৎ কৃষি ও নির্মাণশিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। সারা দেশের স্কুলগামী মেয়ে, শহরাঞ্চলের পোশাক কারখানার নারীশ্রমিক, ছোট-বড় উদ্যোক্তা নারীরা মিলে দেশের প্রচলিত সংস্কৃতিকে অনেকটাই পরিবর্তিত করতে সমর্থ হয়েছে। এই তিন খাতের সাথে যুক্ত কিশোরী ও নারীদের চলাফেরা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে যা নারীর অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।

বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়। রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হারে এবং উচ্চ পর্যায়ের অবস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা ও জেলা পরিষদে, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বেড়েছে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৯৭ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বৃদ্ধি করে নারীদের ক্ষমতায়নে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে নারীরা সাধারণ আসনেই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের অবস্থান অর্জন করার সক্ষমতা অর্জন করেছেন।

শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স, বিচারক, নির্বাচন কমিশনার, পাইলট, পুলিশ এমনসব নানা পেশায় এখন নারীর সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলাদেশে এখন নারীরা জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বেসামরিক প্রশাসনের সচিবপদে কর্মরত আছেন। পুলিশ প্রশাসনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে নারী নিযুক্ত হয়েছেন। আজ থেকে ১০ বছর আগেও মেয়েরা খেলাধুলার ক্ষেত্রে নানান বাধার সম্মুখীন হতো। বর্তমানে তারা সেই বাধার দেয়াল ডিঙিয়ে বিভিন্ন খেলার পাশাপাশি ক্রিকেটেও রাজত্ব করছেন। স্বাস্থ্যখাতে নারীর অংশগ্রহণ অর্ধেকের বেশি।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৬ অনুযায়ী নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণে ১০ বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে ১৯ ধাপ। আর্থ-সামাজিক নানা ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে সাফল্য বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের ৭২তম স্থানে রয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯১তম। সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফোরামের ৫৩তম সন্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেন্ডার গ্যাপ দূরীকরণে সাফল্য বিবেচনায় ভারতের অবস্থান ৮৭তম, চীনের ৯৯তম, জাপানের ১১১তম। পাকিস্তান অবস্থান করছে ১৪৩তম স্থানে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ নারীরাও অনেক এগিয়ে এসেছেন। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন দরিদ্র গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮০ ভাগ নারীকে ঋণ কর্মসূচির আওতায় এনে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে বড় বড় বেসরকারি সংগঠন, সরকারি ব্যাংক ও বিভিন্ন দপ্তর প্রশিক্ষণসহ ঋণ সহযোগিতা প্রদান করছে।

নারীর অধিকার ও মর্যাদা কেবল নারীর অগ্রগতির সাথেই সম্পর্কযুক্ত নয়। মনে রাখা শ্রেয়, নারী-পুরুষের মিলিত বিশ্বে সর্বজনীন প্রগতির প্রতিশ্রুতি। এটি পরিবারের, সমাজের, দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক দেশেই নারীর উন্নয়ন না হওয়ায় সামগ্রিক উন্নয়ন টেকসই হয়নি। আমাদের দেশে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে পশ্চাদমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এক বিরাট বাধা। শিক্ষা এবং নারীর ক্ষমতায়নে আরো অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে বলে বিশ্বাস করি। প্রতিটি কন্যাশিশু ও নারীকে মূল্যায়নের মাধ্যমে পরিবারে ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নিজের অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে নারীর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই।

নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রধান ভূমিকা পালন করে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারের মায়েদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশু বা সন্তানকে ছেলে বা মেয়ে হিসেবে প্রথম বিভাজন শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবার থেকেই যদি এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধিত হয়, তাহলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব। নারী অধিকার আদায়ে শুধু নারী সংগঠন নয়, পুরুষদেরও সোচ্চার হতে হবে। বিভিন্ন আইনের প্রয়োগের জন্য সংগঠন পর্যায় থেকে চাপ প্রদান করতে হবে। আইন শুধু কাগজে-কলমে থাকলেই হবে না। আইনকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হবে। নারীদের পুরুষের মতোই সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে। পুরুষকে পাশে নিয়েই নারীকে এগিয়ে যেতে হবে। টেকসই উন্নয়নে নারীর অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। সেজন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও যাতে নারীর মতামত ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। নারীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে। এটি নারীর ক্ষমতায়নের একটি সূচক। অধিকার কারো থেকে পাওয়ার বিষয় নয়, অধিকার অর্জন করতে হয়।

 

লেখক : সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads