• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

করোনায় আর্থিক প্রণোদনা ও সরকারের সফলতা

  • প্রকাশিত ২১ মে ২০২১

আরজুমান্দ বানু

 

 

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থবিরতা মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত বিভিন্ন সহায়তার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে অনেক আগেই। অনেক প্রণোদনা প্যাকেজ বিতরণ কর্মসূচি শেষ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। কিছু এখনো চলমান। ব্যবসায়িক সহায়তা প্যাকেজ পুরোটাই বাংলাদেশ ব্যাংক বাস্তবায়ন করছে।

২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস। এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে প্রতিদিনের উপার্জনে চলে, এমন খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ, ক্ষুদ্র, মাঝারি ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি। সরকার করোনা ভাইরাসজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রথম প্যাকেজের আওতায় ২০২০ সালে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। এ বছরের জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার আরো দুটি নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার ফলে মোট প্রণোদনা প্যাকেজের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩টিতে, যার মোট আর্থিক পরিমাণ ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশের সমান।

এই প্রণোদনার সুবিধাভোগীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিল্প-কারখানার মালিক, উদ্যোক্তা, কৃষক, শ্রমিক এবং নিম্নআয়ের মানুষসহ সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। সরকার ঘোষিত খাতভিত্তিক প্রণোদনার মধ্যে শিল্পখাতে ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি  টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর ফলে এই মন্দার সময়েও শিল্পকারখানার মালিকরা অতিরিক্ত চাপ ছাড়াই তাদের কর্মী-শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পেরেছেন। পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা, রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডবাবদ ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ঋণবাবদ ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া দেশের নিম্ন আয়ের ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ খাতে সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা, গত রোজার ঈদে দেশের প্রতিটি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনকে ‘ঈদ উপহার’ হিসেবে আর্থিক সহায়তাবাবদ ২ হাজার ৫০০ টাকা করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সারা দেশের নন-এমপিও কারিগরি, মাদরাসা ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫১ হাজার ২৬৬ জন শিক্ষককে জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা এবং ১০ হাজার ২০৪ জন কর্মচারীকে জনপ্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে সর্বমোট ২৮ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক অনুদান হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। করোনাকালীন সংকট মোকাবিলায় ১৩ হাজার ৯২৯টি কওমি মাদরাসার এতিম দুস্থদের জন্য ১৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীন নন-এমপিও ৮০ হাজার ৭৪৭ জন শিক্ষক এবং ২৫ হাজার ৩৮ জন কর্মচারীর অনুকূলে ৪৬ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। সরকারের এসব আর্থিক সহায়তা নগদ, বিকাশ এবং ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান করা হয়েছে।

করোনায় ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত কাজ করছেন ডাক্তার-নার্সসহ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার সাথে সংশ্লিষ্টরা। এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য তাদের অতিরিক্ত এক মাসের বেতন সম্মানি হিসেবে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০০ কোটি টাকা এবং দায়িত্ব পালনকালে মৃত সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। করোনার টিকাবাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরেও করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ জন খামারিকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কাজ হারিয়ে বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। করোনাকালীন খাদ্য নিরাপত্তা সবচেয়ে জরুরি। এজন্য কৃষিতে জোর দিয়েছে সরকার। দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি যাতে আবাদের আওতায় আসে, সে লক্ষ্যে কৃষি ভর্তুকিতে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কৃষির যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ২২০ কোটি টাকা, কৃষি পুনঃঅর্থায়নে ৫ হাজার কোটি টাকা এবং নিম্ন আয়ের কৃষকদের পুনঃঅর্থায়ন স্কিমবাবদ দেওয়া হয়েছে আরো ৩ হাজার কোটি টাকা।

এ বছরের ১৮ জানুয়ারিতে ২ হাজার ৭শ কোটি টাকার দ্বিতীয় প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ১ হাজার ৫শ কোটি টাকা ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাতের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আর ১ হাজার ২শ কোটি টাকা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১৫০টি উপজেলায় দরিদ্র বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্ত নারীদের ভাতাবাবদ ব্যয় করা হচ্ছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্তুদের সহায়তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি এসব মানুষকে কম দামে খোলা বাজারে চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সরকারের ওএমএস খাতে ব্যয় করা হচ্ছে ২৫১ কোটি টাকা। ওএমএস-এর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ট্রাকসেলে বিতরণ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্যাকেজের অর্থ ছাড় চলছে। ধাপে ধাপে এ অর্থ ছাড় করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সার্বিক সহযোগিতা করছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম জানিয়েছেন, করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ব্যবসায়ীরা একযোগে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ঋণ সহায়তা প্যাকেজ কর্মসূচিটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত। এ প্যাকেজের ফলে ব্যবসায়ীদের সার্বিক অর্থে দেশ উপকৃত হয়েছে। করোনাকালে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অর্থনীতি যেখানে হুমকির মধ্যে পড়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ভালো অবস্থায় রয়েছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে।

আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তির এ তালিকায় রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক দোকানের কর্মচারি, পোশাক শিল্প, পোলট্রি শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, হকারসহ কোনো পেশার মানুষ বাদ পড়েনি। সরকারি সহায়তা তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ দূরদর্শী পদক্ষেপ দেশে-বিদেশে মানবিকতা এবং নেতৃত্বের এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

মুজিববর্ষে ২৩ জানুয়ারি ২০২১, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ন প্রকল্প-২-এর আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে ঘর বিতরণ করেছেন। এর জন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করাই মুজিববর্ষের লক্ষ্য, যাতে দেশের প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ পায়। মুজিব বর্ষে গৃহহীনদের ঘর দেয়া দরিদ্রদের জন্য বড় প্রণোদনা।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা থেকে শুরু করে একজন চা দোকানি পর্যন্ত সরকার প্রদত্ত আর্থিক প্রণোদনা একটি সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বৈশ্বিক এ মহামারীর প্রেক্ষাপটে সরকারের আর্থিক প্রণোদনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আবার প্রাণ ফিরে এসেছে। পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে অবহেলিত, দুস্থ এবং দরিদ্র নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্নভাবে সহায়তা করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারের সময়োপযোগী এসব প্রণোদনার ফলে করোনার ক্ষতি কটিয়ে স্বমহিমায় ফিরতে শুরু করেছে বাংলাদেশ, যার কান্ডারি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

 পিআইডি-শিশু ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক যোগাযোগ কার্যক্রম নিবন্ধ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads