• সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ৬ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বিবাহবিচ্ছেদ

সামাজিক চিন্তাচেতনা ও বাস্তবতা

  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০২১

নওশিন বিনতে কাশেম

 

 

 

সম্প্রতি সময়ের বহুল আলোচিত বিষয়ের একটি বিশ্বের বিখ্যাত ধনী দম্পতি বিল গেটস ও মেলিন্ডার বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনাটি। টুইটারে তাদের ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবনের বিবাহবিচ্ছেদের ঘোষণা পাওয়ার পরপরই সামাজিক এবং সংবাদমাধ্যমগুলোতে ইতিবাচক ও নেতিবাচক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখেছি। ‘বিবাহবিচ্ছেদ’ এই শব্দটির মোড়ক উন্মোচনের আগে ‘বিবাহিত জীবন’ নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে নারী পুরুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে আর নতুন একটা পরিবার গঠনের স্বপ্ন নিয়েই দুজন মানুষ সামাজিক প্রথা মেনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। হয়তো কেউ ভালোবেসে চেনা মানুষকেই আপন করে আবার কেউ সম্পূর্ণ অচেনা দুজন মানুষ সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়েই নতুন জীবনের সূচনা করে। প্রতিটি মানুষই খুব শখ করে, আনন্দ নিয়ে নিজের স্বপ্নের মতো করে খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবেই জীবনের এই অধ্যায়টা শুরু করে। ভাঙনের উদ্দেশ্য নিয়ে অবশ্যই না। কিন্তু সংসার বড় অদ্ভুত জায়গা, বড় কঠিন। সংসারে প্রবেশ করেই ধীরে ধীরে মানুষ সম্পর্কের গভীরতা বুঝে, কারো মানিয়ে নেওয়ার আবার কারো মেনে না নেওয়ার গল্প শুরু হয়। খ্যাতিমান লেখক বুদ্ধদেব সাহা উপন্যাসের বিয়ে বিষয়ে বলেছেন—‘বিয়ে! কী জটিল, কঠিন প্রয়োজনীয়, সাংঘাতিক মজবুত একটা ব্যাপার, আর কী ঠুনকো! দুজন মানুষ সারাজীবন একসঙ্গে থাকবে পাঁচ, দশ, পনেরো বছর নয়, সারাজীবন। এর চেয়ে ভয়ংকর জুলুম আর অমানবিক আদর্শ আর কি হতে পারে? সন্তানের সাথে আজীবন থাকি না আমরা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বন্ধু বেছে নিই, কিন্তু আশা কিংবা দাবি করা হয় যে, একবার যারা স্বামী-স্ত্রী হলো তারা চিরকাল তাই থাকবে। এই অস্বাভাবিক অবস্থাটা সহ্য করা যায়! এটাকে ঈশ্বরের বিধান বলে মেনে নিলে, আমাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখলে।’

ব্যক্তি স্বাধীনতা, নিজস্বতা, স্বকীয়তা প্রত্যেকের ভেতরে সহজাতভাবেই আছে যা সমাজিক ব্যবস্থায় অনেক সময় মানতে দেওয়া হয় না। এই সমাজে মনে করা হয় একবার বিয়ে হয়ে গেলে মানে আপনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। সংসারটাকে আমরা যাবজ্জীবন কারাগার বানিয়ে ফেলেছি। আর কারাগার ভাবা হয় বলেই হয়তো আমরা নানারকম অস্বস্তিতে ভুগি, ছোট ছোট বিষয়কে জটিল বানিয়ে নিই। অথচ এই ছোট্ট জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত যদি খুব সহজভাবে নিয়ে নেতিবাচক সবকিছু দূরে ছুড়ে ফেলতে পারতাম তাহলে কত সুন্দর মসৃণ পথ হতো। তবে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে আমরা নিজেদের যত আধুনিক ভাবি না কেন, এখনো প্রতিটা দোষ নারীর দিকেই আঙুল তুলে দেওয়া হয়। ঠিক এরকমভাবে বিচ্ছেদের কাহিনী আর নেতিবাচক দিক পুরুষেরও আছে; কিন্তু সমাজে তাদের বিষয়গুলোকে যতটা সহজে মেনে নেওয়া হয় একজন নারীর বিষয়টা কখনো সেভাবে নেওয়া হয় না। আর তাই যুগ যুগ ধরে কত মানসিক অশান্তি আর লৌকিকতার জন্য বা সমাজ কি বলবে এই ভেবে দুজন মানুষ না চাইলেও হয়তো অনেক প্রাণহীন সম্পর্ক চালিয়ে যায় যেখানে কোনো ভালোবাসার ছোঁয়া নেই, সম্মানের কোনো বালাই নেই। কিন্তু যদি পারস্পরিক সম্মানবোধ নিয়ে একটু ইতিবাচকভাবে দুজন দুজনকে সহযোগিতা করে নিজেদের একটু বোঝার চেষ্টা করি তাহলে কত সুন্দর একটা পবিত্র সম্পর্ক আমরা ভালোবাসা দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠত।

কিন্তু এই আধুনিক যুগে আমরা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক হয়েছি যে আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমে গেছে, সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে গেছে, দিনদিন মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে আর তাই বর্তমানে দেখা গেছে শিক্ষিতদের মাঝে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে মূলত নারীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন আর আত্মনির্ভরশীল। আর বিশেষ যে কারণে বিচ্ছেদের হার বাড়ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পারস্পরিক সম্মানবোধের অভাব, ভুল বোঝা, অর্থনৈতিক ঝামেলা, ইগো, পরকীয়া, যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, শারীরিক সম্পর্কের দূরত্ব ইত্যাদি।

এ ছাড়া খুব ছোট ছোট বিবাদ থেকেও নিজেদের সম্মান আর মানসিক শান্তির কথা ভেবে মানুষ এখন সমাজের ভয়ে অভিনয় করে সম্মান টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী না। যদি সমাজে একজন মেয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যেতে চায় অনেক স্বামী তা মানতে নারাজ, তখন সমাজ সম্পর্কের দূরত্ব নিয়ে কথা বলতে আসে। কিন্তু একই চিত্র গ্রামাঞ্চলে বা বিদেশে অবস্থানরত স্বামীদের ক্ষেত্রে হলে কেউ প্রশ্ন তোলে না। যুগের পর যুগ কত মেয়ে প্রবাসী বিয়ে করে স্বামীর সংসার বোঝার আগেই দেশে একা জীবন পার করে সারাজীবন। এই সম্পর্কগুলো কতটা অস্বাস্থ্যকর, মানসিক কষ্টদায়ক কিংবা ধর্ম পরিপন্থী সে বিষয়ে কেউ কথা বলে না।

অথচ এই বিষয়গুলো গ্রামাঞ্চলে অতটা গুরুত্ব না দিলেও শহরাঞ্চলে শিক্ষিত নারী পুরুষ উভয়ের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, তারা নিজেদের ভালো থাকা নিয়ে ভাবছে, লোক দেখানো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা নিয়ে ভাবে না। যে যার মতো ভালো থাকার অধিকার সবার আছে। অবশ্যই যে হাত সারাজীবন একসাথে চলার জন্য ধরা হয় সেটা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা সবার আন্তরিকভাবে চালিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু যখন মতামত আর মানসিকতা মিলে না তখন অবশ্যই তাদের মতামতকে শ্রদ্ধা জানানো উচিত, কটূক্তি না করে। পৃথিবীর সবকিছুই পরিবর্তনশীল, মানুষও ব্যতিক্রম নয়। মন বদলায়, ভালোবাসার রং বদলায়, নতুন করে নিজেদের মতো করে মানুষের বাঁচার ইচ্ছা জাগে। কাজেই কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা না রটিয়ে; বরং সম্মান জানিয়ে আমরা কি তাদের বাঁচতে দিতে পারি না?

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads