• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মিয়ানমারের অন্তর্কলহ

দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আসন্ন সংকট

  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০২১

আকিজ মাহমুদ

 

 

রোহিঙ্গাদের ওপর যখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছিল, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী থেকে শুরু করে বিশ্বের সব সচেতন নাগরিক মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সেদেশেরই গণতন্ত্রকামী নেত্রী অং সান সু চির বিমূর্ত এক ন্যায়সংগত সাহসী পদক্ষেপ দেখতে উদগ্রীব ছিল। কিন্তু একসময়ের গণমানুষের হয়ে রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করা সেই নেত্রীই কি-না গণবিদ্বেষী অপকর্মের সাথে নির্দ্বিধায় আপস করে নিলেন!

২০১৭ সালে সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নৃশংস গণহত্যাকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সু চি অস্বীকার করে বসেন। রোহিঙ্গা গণহত্যার মতো একটা বিশ্বনিন্দিত ঘটনাতেও তিনি অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষেই সাফাই গেয়েছেন। সু চির কৌশল ছিল সেনাবাহিনীর পড়তি জনসমর্থনকে কাজে লাগিয়ে এবং মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রোহিঙ্গাবিদ্বেষের সংযোগ ঘটিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে সুকৌশলে দেশটির ক্ষমতা থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দেবেন। উল্লেখ্য, দেশটিতে উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বরাবরই রোহিঙ্গা গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষপাত করেছে। সু চির মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত সেনাবাহিনীর আস্থা অর্জন করা,  দ্বিতীয়ত দেশটির অভ্যন্তরীণ রোহিঙ্গাবিদ্বেষী বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তাকে আঁকড়ে ধরে রাখা। সু চি এর ফলও পেয়েছিলেন ২০২০ সালের নভেম্বরের মিয়ানমারের নির্বাচনে, বিপুল ব্যবধানে অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) তাদের প্রধান বিরোধী দল সেনা সমর্থিত ইউএসডিপির বিরুদ্ধে জয়লাভ করে।

নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী সু চির এনএলডি সরকার গড়তে সেনাবাহিনীর চরম বাধার সম্মুখীন হতে থাকে। নির্বাচন-পরবর্তী দেশটিতে রাজনৈতিক এই দ্বন্দ্বে দেশটিতে পুনরায় সেনা অভ্যুত্থানের বিষয়টি অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। এরই প্রেক্ষিতে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে, কোনো রক্তপাত ছাড়াই ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় দেশটির সেনা জেনারেলরা। একইসাথে সু চিকে তারা অবরুদ্ধ করে রাখে। অং সান সু চিকে আটকের পাশাপাশি শাসক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রায় সব পরিষদ সদস্যকে বন্দি করে রাখে।

উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হওয়ার প্রাক্কালে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব অং সান সু চি দেশটির গণতন্ত্রকামীদের বিক্ষোভ প্রতিরোধের আহ্বান জানান। মিয়ানমারের সেনাশাসনের প্রতিবাদে দেশটির সাধারণ গণতন্ত্রকামীদের সু চির ডাকে সাড়া দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার যে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছে। সামরিকদের জারি করা কারফিউ এবং বিধিনিষেধ অমান্য করে বিক্ষোভ করতে গিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক নৃশংস হামলার শিকার হতে হচ্ছে দেশটির নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের। মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীদের এই বিক্ষোভ ক্ষমতালোভী সেনাবাহিনী চরম কঠোরতা অবলম্বন করেও দমিয়ে রাখতে পারেনি। বরং পুরো মিয়ানমারে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে, যা ক্রমেই দেশটিতে গৃহযুদ্ধের রূপ নিচ্ছে।

একটি দেশের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, কলহ বা গণহত্যা তার পার্শ্ববর্তী দেশেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যা তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, আরেকটি উদাহরণ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ সিরিয়ার নামও উল্লেখ করা যায়। একটি দেশের গৃহযুদ্ধ যে তার আশপাশের অঞ্চলেও অশান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে তা আমরা মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া ইস্যু থেকে অনুধাবন করতে পারি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা গণহত্যা যে প্রভাব তা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে।  দেশটিতে সেনাশাসনবিরোধী এই বিদ্রোহ যদি পূর্ণাঙ্গ গৃহযুদ্ধে রূপ নেয় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় উল্লেখিত দেশগুলো তথা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিবেশের সূচনা হতে পারে। যার প্রভাব রোহিঙ্গা সমস্যার চেয়েও ভয়ংকর আকারে বাংলাদেশসহ উল্লেখিত দেশগুলোতে নতুন বৈশ্বিক সংকট হিসেবে উদ্ভূত হতে পারে।

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির সেনাবাহিনী জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করলেও পার্শ্ববর্তী শক্তিধর এবং পরিস্থিতি উত্তরণের সবচেয়ে নিয়ামক দেশ চীনের ভূমিকা ছিল নীরব। সু চির প্রতি কোনো সমর্থন না জানিয়ে চীন বরং জান্তাদের দীর্ঘদিনের পুরনো মিত্রতার পরিচয় দিয়েছে। মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানকে চীন আখ্যা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদের রদবদল হিসেবে। বিশেষজ্ঞরা মিয়ানমারের এই সামরিক অভ্যুত্থান চীনের মদতে ঘটেছে বলে উল্লেখ করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা চীন ভারতের প্রভাব রুখতে এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় এই অঞ্চলটিতে চীনের একক উপস্থিতির লক্ষ্যে চীনপন্থী জান্তাদের অকুণ্ঠ সামর্থন জানিয়ে আসছে। চীন মিয়ানমারে আগের যেকোনো সময় অপেক্ষা সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে, এছাড়া মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো উন্নয়নে দেশটিতে আছে চীনের একক উপস্থিতি। এছাড়া চীনের স্বপ্নের সিল্ক রোড (ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড) পরিকল্পনায় মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূখণ্ডে অবস্থান করছে। সু চির হাতে মিয়ানমারের সম্পূর্ণ ক্ষমতা চলে গেলে তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সাথেও সম্পর্ক এগিয়ে নেবেন এবং মিয়ানমারকে তিনি চীনের একক প্রভাব থেকে বের করে আনতে চেষ্টা করবেন, এমনটি ধারণা চীনের ক্ষমতাসীন  কমিউনিস্টদের। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে চীনের সমর্থন জানানোর দুটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত চীনের প্রস্তাবিত সিল্ক রোডে ভারত অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছুক নয় এবং বাংলাদেশের নিরপেক্ষ ভূমিকা চীনকে বঙ্গোপসাগর সাগর অঞ্চলে মিয়ানমারের প্রতি বেশি ঝুঁকতে বাধ্য করেছে। আর এজন্য চীন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের খুব বিশ্বস্ত মিত্র পেতে চায়। আর এই মিত্র তাদের জন্য কেবল দেশটির সেনাবাহিনীই হতে পারে। দ্বিতীয়ত চীন যদি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন জানায় তাহলে দেশটির সেনাবাহিনী পুনরায় ক্ষমতায় গেলেও সবচেয়ে বেশি চীনের ওপরই নির্ভরশীল থাকবে।

জান্তাদের প্রতি চীনের এই সমর্থনকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ভূরাজনৈতিক অবস্থা দৃঢ় করার অন্যতম একটা পরিকল্পনাও বলা যেতে পারে। মিয়ানমারের জনগণের সামরিক শাসনে দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততা চীনকে এই পরিকল্পনা সাজাতে উৎসাহী করেছে। আর এজন্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সকল কাজকে অন্ধ সমর্থন জানিয়ে আসছে, হোক সেটা ভালো কিংবা মানবতাবিদ্বষী রোহিঙ্গা গণহত্যার মতো নিকৃষ্ট অপরাধ। মিয়ানমার ইস্যুতে আঞ্চলিক অপর শক্তিধর দেশ ভারতও অনেকটা নীরব অবস্থান বজায় রাখছে। কেননা ভারত মিয়ানমারে চীনকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। এজন্য ভারত তাতমাডো’র এই ধৃষ্টতায় বিচলিত হলেও কঠোর কোনো অবস্থান নিচ্ছে না। তবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীরা যে আশায় সম্ভাবনার উজ্জ্বল দিশা খুঁজে পেতে পারে তা হচ্ছে, বিশ্ব রাজনীতির নিয়ামক দেশ আমেরিকার হস্তক্ষেপে বিশ্বের অনেক দেশই এখন মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ প্রয়োগের কথা বলছে।

মিয়ানমারের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হচ্ছে, দেশটি একটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হওয়া মানে এর সরাসরি প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ওপর পড়া। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ বাধলে আর তা সামাল দিতে চীন যদি কোনোক্রমে তাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তাহলে এটা নিশ্চিত যে, এই অঞ্চল বড় ধরনের যুদ্ধাবস্থার সম্মুখীন হবে। আর এমনটি যদি ঘটে চীনবিরোধী জোট বঙ্গোপসাগরীয় সমুদ্রসীমাকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ দমাতে ব্যবহার করতে চাইবে। অর্থাৎ ক্রমাগত বৈশ্বিক শক্তিধর দেশগুলোর চাপ বাংলাদেশের ওপর বাড়বে। যদি কোনো দেশ সরাসরি মিয়ানমারের এই যুদ্ধে নাও জড়ায়, সেক্ষেত্রে বিদ্রোহীরা ভারত তথা আমেরিকার সমর্থন পেয়ে যাবে এবং সামরিক বাহিনী যথারীতি চীনের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, এতে করে গৃহযুদ্ধটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর দীর্ঘদিন এই গৃহযুদ্ধ বিরাজমান থাকলে দেশটির প্রচুর সংখ্যক লোক শরণার্থী হিসেবে সীমান্তবর্তী দেশগুলোকে বেছে নেবে আশ্রয়ের জন্য। আর বাংলাদেশ হতে পারে এসব শরণার্থীর অন্যতম গন্তব্য। তাছাড়া সীমান্ত চোরাচালান, অস্ত্রপাচারসহ নানা অপকর্মের দ্বারা মিয়ানমার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীল অবস্থা বিনষ্ট হওয়ার আশংকা থেকেই যায়।

সু চির রাজনৈতিক দর্শনে সবচেয়ে বড় ভুল হয়তো রোহিঙ্গা সংকটকে পাশকাটিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর পক্ষাবলম্বন করা। সু চির এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিকভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকহারে হ্রাস করেছে। রোহিঙ্গাদের মানবিক বিপর্যয়ে যেখানে দেশটির সাধারণ মানুষ এবং অবিসংবাদিত নেত্রী অং সান সু চির রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান জরুরি ছিল, সেখানে তারা স্বদেশের কাউকেই তাদের পাশে পায়নি। সময়ের কি নিষ্ঠুর প্রতিবাদ, সেই দিনে সু চি যাদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন তাদের বন্দুকের নলের নিশানা এখন সু চির দল এবং সেই সব মানুষের দিকে, যারা রোহিঙ্গা গণহত্যাকে তাদের সেনাবাহিনীর জন্য এক প্রকার বৈধতা দান করেছিলেন। আজ তারাই ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে সেনা সমর্থিত সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষাস্বরূপ লিখছে,  ‘আমরা ভুল বুঝতে পারছি, রোহিঙ্গারা আমাদের ক্ষমা করো’।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads