• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

জি-সেভেন সম্মেলন : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

  • প্রকাশিত ২৬ জুন ২০২১

অলোক আচার্য

 

ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালে ১১ থেকে ১৩ জুন পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী আয়োজিত জি-সেভেন সম্মেলন বিশ্বকে করোনামুক্তসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে। এবারের এজেন্ডা হিসেবে একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা, জলবায়ু ইস্যু ছিল। বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির সাতটি দেশ ও একটি সংস্থা নিয়ে গঠিত এই জোটের কাছে বিশ্বের প্রত্যাশাও থাকে বেশি। সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে বর্তমানে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছে যেখানে সর্বত্রই অস্থিরতা। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রাণহানির সাথে সাথে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইথিওপিয়া, ইয়েমেন করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি খাদ্যসংকটের কবলে পড়েছে। ইথিওপিয়ার সংঘাতপ্রবণ তিগ্রাই অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের কবলে আছে। পৃথিবীকে এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তবে এর চেয়েও বড় সমস্যা এখন করোনাভাইরাস। পৃথিবীকে প্রায় থমকে দিয়েছে। করোনা মহামারিতে পৃথিবী নামক গ্রহ আজ বিপর্যস্ত। সেই মহামারি থেকে জি-সেভেন-এ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোও রেহাই পায়নি। সুতরাং জি-৭-এর প্রথম কাজ ছিল মহামারি নিয়ে কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তে আসা, যা পৃথিবীকে স্বস্তি দিতে পারে।

এই জোটের নেতারা দরিদ্র দেশগুলোকে ১০০ কোটি টিকা দিতে অঙ্গীকার করেছেন। মহামারি প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো টিকা। টিকা কার্যক্রমের শুরুতেই ধনী রাষ্ট্রগুলোর বৈষম্যের পরিণতিতে টিকা প্রদানে উন্নত দেশগুলো এগিয়ে যায়। বিপরীতে পিছিয়ে পরে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো। পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে গেলে প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক টিকা। আর পৃথিবীর প্রতিটি দেশ যদি টিকা না পায় তাহলে করোনামুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলায় বৈশ্বিক প্রাথমিক উদ্যোগ কিছু স্বার্থপর ও জাতীয়তাবাদী প্রস্তাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনাকে বিদায় জানাতে আমাদের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সামর্থ্যও এসবের কারণে বাধাগ্রস্ত হয়।  কার্যত এবারের জি-৭ সম্মেলনে মনোযোগ ছিল কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এবং এই মহামারি ঠেকাতে কি পদক্ষেপ নেয় সম্মেলনের নেতারা। সেক্ষেত্রে পৃথিবী কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছে। অন্তত টিকার ক্ষেত্রে। যেখানে পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন টিকার সংকট। তাছাড়া করোনা ভাইরাস মহামারির মতো জীবন ও জীবিকা বিবধ্বংসী আর কোনো বৈশ্বিক মহামারি যাতে ভবিষ্যতে না হয়, তা ঠেকানোর লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণের ঘোষণা চূড়ান্ত করেছেন নেতারা।

এই পরিকল্পনায় রয়েছে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা এবং টিকা উদ্ভাবন ও অনুমোদনের সময়সীমা ১০০ দিনের মধ্যে নামিয়ে আনা, সম্ভাব্য সংক্রামক রোগের আবির্ভাবের ওপর নজরদারির জন্য বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করা, জিনোম সিকোয়েন্সিয়ের সক্ষমতা বাড়ানো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংস্কার এবং তাকে শক্তিশালী করা। শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন হলো জি সেভেন। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশের প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক, সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী এবং একত্রিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা। সম্মেলন থেকে তাই প্রত্যাশা ছিল বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের। জি-৭ সম্মেলনেও আলোচনায় ছিল চীন প্রসঙ্গ। মতবিরোধ এবং বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতি দূর করতে এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ছিল। বিশ্ব এখন নানা কারণে সংকটে রয়েছে। বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভূরাজনীতি ক্রমেই অস্থিতিশীল এবং পরিবর্তন হচ্ছে। এককভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে মোড়ল দেশগুলো নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে গড়ে উঠছে শক্তিশালী বলয়। সেখান থেকেই নিজেদের কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টায় নিজ নিজ প্রভাব খাটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

চীনকে ঠেকাতে বিথ্রিডব্লিউ (বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড) প্রকল্প আনছে সাত দেশ। বেইজিংয়ের ট্রিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বিআরআই’র (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনফ্রাষ্ট্রাকচার ইনিশিয়েটিভ) পাল্টা হিসেবেই এই প্রকল্প আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই পরিকল্পনার আওতায় রাস্তাঘাট নির্মাণ ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন এগিয়ে নিতে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে তহবিল দেওয়া হবে। চীন ২০১৩ সালে এই বিআরআই প্রকল্প গ্রহণ করে। এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ১০০টির বেশি দেশ যুক্ত হয়েছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বরাবরই প্রতিযোগিতামূলক। চীনকে উঠতি পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্রমেই চীন তার প্রভাব বলয়ের বিস্তৃতি বৃদ্ধি করছে।

বিশ্ব মোড়ল হওয়ার দৌড়ে যখন পরাশক্তিগুলো ছুটতে থাকে তখন প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। বলয় শক্তিশালী করার দৌড়ে চীন এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। করোনার উৎস নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কথার লড়াই হয়েছে এবং হচ্ছে।  যদিও করোনা মহামারির সময় সারা বিশ্বের একত্রিত হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, জোট পরিকল্পনা প্রভৃতি সবকিছুই সমানতালে চলেছে। দুই দেশের এই প্রতিযোগিতা মূলত ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ শব্দটির দিকে ইঙ্গিত বহন করে। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই বাণিজ্য যুদ্ধ দিয়ে টানাপোড়েনের শুরু হয়। তার প্রশাসন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। এরই জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। আর এতেই শুরু হয়ে যায় দুদেশের বাণিজ্য যুদ্ধ। তৈরি হয় উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা আজও চলছে। বাণিজ্য যুদ্ধ ছাপিয়ে এখন করোনা নিয়ে বািবতণ্ডা তৈরি হয়েছে। অবশ্য করোনা ভাইরাসের নির্ধারিত উৎস এখনো জানা যায়নি। বহু সম্ভাবনা সামনে এসেছে। কিন্তু নিশ্চিত হওয়া যায়নি। করোনার শুরু থেকেই এটি একটি ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় দুই দেশের মধ্যে। মূলত দুই দেশের মধ্যে যে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে তা বেরিয়ে আসে। সেই বিষয়টিই নতুন করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বার বার।

জি-৭ নেতাদের পরিকল্পনায় জলবায়ু ইস্যু এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে। করোনা মহামারি পৃথিবীর সাময়িক সংকট, যা অন্য মহামারিগুলোর মতোই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে এক সময়। কিন্তু জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি এবং হতে যাচ্ছি যার ফলে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে তা বুঝতে পারছি। ফলে এটি ছিল অন্যতম প্রধান আলোচ্য ইস্যু। সব সদস্য দেশই তাদের কার্বন নিঃসরণ নীতিগতভাবে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে আনতে সম্মত হয়েছেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উন্নত এবং উন্নত হওয়ার পথে অতিক্রমকারী প্রতিটি দেশকেই এই কার্বন নিঃস্বরণ মাত্রা কমিয়ে আনতে একসাথে কাজ করতে হবে। আবার তাদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রার ফলে যে জলবায়ু প্রতিক্রিয়ার তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে তার ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোকে। তাদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা জি-৭ এর মতো উন্নত দেশগুলোর করা উচিত এবং বাস্তবায়ন করা উচিত। যদিও শতকরা ২৭ ভাগ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী চীন জি-৭ এর অন্তর্ভুক্ত দেশ নয়। সেক্ষেত্রে সবাই একসাথে কাজ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে সময়ের প্রয়োজন হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আরো ইতিবাচক ভূমিকাই প্রত্যাশা করা হয়। জি সেভেনের শিল্পোন্নত দেশগুলোও চায় এই অবস্থার অবসান হোক। প্রথমে পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে হবে। এজন্য চাই টিকার সমবণ্টন। টিকার একটি বড় অংশই রয়েছে এসব শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছে। অন্যদিকে টিকা সংকটে ভুগছে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো। টিকার সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করা এবং তা প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায়িত্ব। মোট কথা এ দেশসমূহকে পৃথিবীর স্বার্থে কাজ করতে হবে। জি-৭ এর দেশগুলোর ওপর পৃথিবীর আস্থার বাস্তবায়ন সময়ের দাবি।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী 

sopnil.roy@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads