• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

আশ্রয়ণ প্রকল্প

সরকারের একটি শুভ উদ্যোগ এবং কিছু কথা

  • মামুন রশীদ
  • প্রকাশিত ০৬ জুলাই ২০২১

সমালোচনা করা সহজ। আর সে সমালোচনা যদি সরকারের হয়, তাহলে তো কথাই নেই। সবচেয়ে সহজ এই কাজটি করতে সময় লাগে না। বিষয়েরও অভাব হয় না। আবার এর বিপরীতে ভালো কাজের প্রশংসায় আমাদের কৃপণতাতেও জুড়ি মেলা ভার। আমরা প্রশংসা করতে জানি না, কিন্তু প্রশংসা পেতে ভালোবাসি। ফলে অনেক ভালো কাজ, ভালো উদ্যোগ চাপা পড়ে যায়। অথচ ভালো কাজের, ভালো অংশের প্রচার অন্যকেও উৎসাহিত করে, প্রেরণা জোগায়। কিন্তু নেতির দিকেই আমাদের নজর। অসংখ্য ভালোর উদাহরণ আমাদের সামনে জমা হলেও, আমরা নেতিবাচক প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করতেই পছন্দ করি। লেখা শুরুর আগে পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই বহুল চর্চিত একটি গল্প। ছেলেবেলা থেকে নেতির মধ্যে বড় হওয়া এক শিশুকে সবসময়ই বলা হয় নেতিবাচক কথা। তাকে বলা হয়, সে ভালো স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না। এই নেতিবাচক কথাকে ভুল প্রমাণ করে যখন সে ভর্তি হলো, তখন শুনলো, ভালো রেজাল্ট তো দূরের, পাসও করতে পারবে না। এসব নেতির বেড়া ডিঙিয়ে একসময় সে শিক্ষাজীবন শেষ করলো। তখন তাকে বলা হলো, পান করেছো কিন্তু কপালে চাকরি জুটবে না। একসময় সে চাকরিও পেলো। এখন? তখন বলা হলো, চাকরি পেয়েছো ঠিকই কিন্তু বেতন আর জুটবে না। বেগার খাটতে হবে। মাস শেষে সে যখন প্রাপ্য মজুরিও ঠিকঠিক পেয়ে গেল, তখন বলা হলো, বেতন পেয়েছো ভালো কথা। কিন্তু চাকরিজীবন শেষে পেনশন আর পাবে না। এখন যুবক পেনশন পাবে কি-না, তার অপেক্ষা আমাদের করতেই হবে। গল্পের পাঠকের মতো আপাতত সেই পেনশনের অপেক্ষা করতে করতে সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একই বিষয়ে কয়েকটি নেতিবাচক খবর জেনে নিই।

এক. ৩০ জনু ২০২১। বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় হস্তান্তরের কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে পড়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্যোগ সহনীয় ঘর। বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে ভূমিহীনদের দেওয়া ঘরের এক পাশের মাটি ধসে গেছে খালে। এতে বেশ কয়েকটি ঘর ভেঙে পড়েছে। আতঙ্কে প্রকল্পের বাকি ঘরগুলোতেও থাকছে না বাসিন্দারা।

দুই. ১৭ জুন ২০২১। মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া দরিদ্র গৃহহীনদের কাছ থেকে নেওয়া পরিবহন ও মিস্ত্রি খরচের ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকাও ফেরত দিয়েছেন ইউএনও।

তিন. ১২ জুন ২০২১। ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ নির্মাণাধীন ঘরের লিনটনের ওপর থেকে রডসহ টিনের চালা উড়ে যায়। ছিটকে পড়ে দরজা। ১০ জুন সন্ধ্যায় দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর আলাদীপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামের আশ্রয়ণ প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১০ মে এই একই প্রকল্পের পাঁচটি ঘরের টিনের চালা উড়ে যায়। ভেঙে পড়ে বারান্দার পিলার। এক মাসের মাথায় একই ধরনের ঘটনায় ঘর পাওয়া গৃহহীন ও ভূমিহীনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

চার. ১১ জুন ২০২১। নওগাঁর বদলগাছীতে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙে পড়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য নির্মিত ঘরের দেয়াল। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করায় বাড়ির দুটি দেয়াল ভেঙে পড়ে। উপজেলার সদর ইউনিয়নের জিয়ল গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে।

নেতিবাচক খবরগুলোর সবই সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্প প্রসঙ্গে। যেখানেই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে পড়ার খবর এসেছে, সংবাদমাধ্যমে সেসব এলাকার স্থানীয়রা ঘর নির্মাণে নিম্নমানের ইটের ব্যবহার, প্রয়োজনীয় সিমেন্ট না দেওয়াসহ নানান অভিযোগ করেছেন। এ অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা যেমন জরুরি, তেমনি নির্মাণের অল্প সময়ের মধ্যেই কেন ঘরগুলো ভেঙে পড়লো, তার সঠিক তদন্তও জরুরি। সরকার ভালো উদ্যোগ নিয়েছে, বিপুলসংখ্যক ঘরহীন মানুষকে থাকার জায়গা করে দিচ্ছে, মানবিক এই শুভ উদ্যোগটি অল্প কিছু মানুষের অসততায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে, তা যেমন কাজের কথা নয়, তেমনি এত বড় একটি উদ্যোগে সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিও থাকা অস্বাভাবিক নয়। এখন পুরো বিষয়টিকে প্রশ্নহীন করে তুলতে সবচেয়ে আগে জরুরি সচেতনতা।

সরকার সারা দেশে প্রথম দফায় ৬৬ হাজার ১৮৯টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে এবং দ্বিতীয় দফায় আরো ৫৩ হাজার ৩৪০ পরিবারকে দুই শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর উপহার দিয়েছে। এর আগে সারা দেশে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৬২২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের তালিকা হয়। যাদের কাছে পর্যায়ক্রমে ২ শতক জমির রেজিস্ট্রি মালিকানা দলিল হস্তান্তরসহ দুই রুমের সেমি পাকা টিনশেড বাড়ি হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলমান। যেসব বাড়িতে থাকছে বিদ্যুৎ ও পানির নাগরিক সুবিধাও। ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে আশ্রয়ণ নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পুনর্বাসিত হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ৫২টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবার। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষে সরকার নানা অনুষ্ঠানের ও কাজের যে যে পরিকল্পনা করে, তারই অন্যতম ঘরহীন বিপুলসংখ্যক মানুষের মাঝে একযোগে ঘর দেওয়ার উদ্যোগ। ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘মুজিববর্ষের অনেক কর্মসূচি আমাদের ছিল। সেগুলো আমরা করোনার কারণে করতে পারিনি। তবে করোনা একদিকে আশীর্বাদও হয়েছে। কারণ আমরা এই একটি কাজের দিকেই (গৃহহীনকে ঘর করে দেওয়া) নজর দিতে পেরেছি। আজকে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব।’

প্রায় সতেরো কোটি জনগোষ্ঠীর এই দেশে এখনো অসংখ্য মানুষ ঘরহীন, আশ্রয়হীন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার জন্মশতবর্ষে, সবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগটি মহৎ। খুব দ্রুততম সময়ে উপকারভোগীদের হাতে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ থেকে ঠিকাদার নিয়োগের মতো জটিল আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে সরাসরি ঘর নির্মাণ কাজের যে সফলতা, নির্ধারিত সময়ে উপকারভোগীদের কাছে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়ার যে আনুষ্ঠানিকতা, তাও প্রশংসার দাবিদার।

এত বড় একটি মহৎ উদ্যোগের মাঝে দুর্নীতি-অনিয়মের হাতে গোনা যে চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, তা কিন্তু পুরো প্রকল্পের চিত্র না। বরং এই নেতিবাচক খবরগুলোর মাধ্যমে আমাদের আরো সচেতন, আরো সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। প্রত্যেক ভালো কাজের শুরুতে, ভালো কাজে এমন বাধা আসে। কিন্তু সে বাধায় থেমে যায় না বড় কাজ। এখন এই ঘরগুলো যেন মানুষের কাজে লাগে, এর সঠিক ব্যবহার হয়, সে দিকটি নিশ্চিত করতে হবে। যাদেরকে ঘর দেওয়া হয়েছে, তারা যেন ঘরে থাকতে পারে, এলাকায় থাকতে পারে সেজন্য সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায় থেকেও উৎসাহিত করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগই শুধু নিশ্চিত করতে পারে ঘরগুলোর সঠিক ব্যবহার। মানুষের মাঝে শহরমুখী হওয়ার যে প্রবণতা, তা কাজের জন্যই। কাজের অভাবেই শহরমুখী হওয়ার হার বেশি।

এই জনস্রোতকে গ্রামমুখী করতে বর্তমান সরকার এর আগে ‘একটি বাড়ি একটি খামারে’র মতো যুগান্তকারী কর্মসূচি গ্রহণ করে। জনকল্যাণমুখী এই প্রকল্পগুলো যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, কোটি কোটি টাকা যেন জলে না যায়, সেজন্যই সরকারের এই কার্যক্রমগুলোর সঠিক দেখভাল প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদে এসব কর্মসূচি যেন ফলপ্রসূ হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। ইতোপূর্বে অন্যান্য সরকারের সময়ে ‘গুচ্ছগ্রাম’ প্রকল্পের মতো জনকল্যাণমুখী কর্মসূচির কথাও আমরা জানি। এসব প্রকল্পের আওতায় যারা সুবিধা পেয়েছিলেন, তাদের বর্তমান অবস্থা বা প্রকল্পগুলোর পেছনে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়, সেগুলোর সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে কি-না, তা জলে গেছে কি-না, বর্তমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে পেছনের প্রকল্পগুলোর বিষয়েও নজর দেওয়া জরুরি। তাতে করে বর্তমান প্রকল্পগুলোর দুর্বলতাও খুঁজে বের করা সহজ হবে।

২০২১ সালে দাঁড়িয়ে একটি কথা স্পষ্ট যে, আমরা এগিয়েছি। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। যে বিশ্বাস নিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, দেশ স্বাধীনের পেছনে যে স্বপ্ন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা আজ আর স্বপ্ন না, তা এখন বাস্তবায়নের পথে। এ এক অসাধারণ সাফল্য। বর্তমান সময়ে শুভচিন্তক সকল মানুষকে এক হতে হবে, যাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ফাঁদে পড়ে ম্লান না হয়ে যায়, সরকারের সাফল্য। সেইসঙ্গে এখন আমাদের মনোযোগের কেন্দ্র হওয়া প্রয়োজন, ঘর পাওয়া মানুষগুলোর কর্মক্ষমতা কাজে লাগানোর দিকে। যাতে জাতীয় উৎপাদনে তারাও শামিল হতে পারেন।

 

লেখক : কবি, সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads