• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

নেলসন ম্যান্ডেলা

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা

  • প্রকাশিত ১৭ জুলাই ২০২১

অলোক আচার্য

 

‘আমি সাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি এবং আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি আদর্শিক গণতন্ত্র এবং মুক্ত সমাজের প্রশংসা করি, যেখানে সকল ব্যক্তি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করবে এবং সমান সুযোগ লাভ করবে। এটি হচ্ছে একটি আদর্শিক অবস্থান, যার মধ্য দিয়ে বাঁচা দরকার এবং আমি তা অর্জনের আশা করি, কিন্তু এটি এমন এক আদর্শ, যদি প্রয়োজন পড়ে, তার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ এই কথাগুলো এমন একজন মানুষের যিনি তার জীবনের সব শক্তি দিয়ে বৈষম্য, ভেদাভেদ, অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। বিশেষ করে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একজন সাহসী নেতা হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা।

পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম নেয় যারা স্রোতে গা ভাসায় না। যারা প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করে। তখন সমাজে ধারণার পরিবর্তন ঘটে। এই যেমন বর্ণবাদ। এখনো বর্ণবাদ পৃথিবী থেকে দূর হয়নি। কিন্তু মানব জাতির একটি বড় অংশই বর্ণবাদের বিপক্ষে। বর্ণবাদকে ঘৃণা করে। বর্ণবাদ বলতে মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার ঐ সময়ের শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যকার ব্যাপক ভেদাভেদ বোঝানা হয়। সময়ের সাথে সাথে বর্ণবাদ ধারণাটি আরো বিস্তৃত হয়েছে। ঘৃণা করলেও এক শ্রেণির মানুষ আজো অন্তরে বর্ণবাদকে জিইয়ে রেখেছেন। মাঝেমধ্যেই সেই খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখি। খেলার মাঠ থেকে শুরু করে সবখানেই এই বিদ্বেষ লক্ষণীয়। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যার মধ্য দিয়ে আবার নগ্নরূপে বর্ণবাদ সামনে চলে আসে। বিশ্বজুড়েই এর তীব্র প্রতিবাদ হয়। বর্ণবাদ দ্বারা সেই দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাজ বোঝানো হয় যেখানে কোনো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্যই উঁচু-নিচু বা কর্তৃত্ববাদ এবং ব্যাপকভাবে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া বা বঞ্চিত করা বোঝানো হয়। শরীরের রঙের ভেতরই কেবল এই ভেদাভেদ সীমাবদ্ধ নেই। বর্ণবাদ আসলে একটি প্রভেদ নির্দেশ করে, যা ব্যক্তিকে সামাজিকভাবে হেয় করে এবং কখনো কখনো এটি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গশাসিত সরকার পৃথককরণ নীতি যা আপার্টহাইট নামে পরিচিত, এর মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ, শেতাঙ্গ, দক্ষিণ এশিয় বা বর্ণসংকর এসব বর্ণে ভাগ করে অশ্বেতাঙ্গদের বাসস্থান, নির্বাচনের অধিকার, যাতায়াতের অধিকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক অধিকারসহ নানাভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এসব কিছুর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের প্রতীক ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি এ বিশ্বের এক মহান আদর্শিক নেতা। ১৯৬৪ সালে রিভোনিয়া ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলাকালে প্রদান করা বক্তৃতায় তিনি এসব বলেন। তার আরো মূল্যবান বক্তব্য থাকলেও এই একটি কথাতেই তিনি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করার দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার মহান এই নেতা ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। পৃথিবীতে যুগে যুগে সাদা চামড়া-কালো চামড়া নিয়ে বিভেদ চলে এসেছে। আজকের এই প্রগতিশীল পৃথিবীতেও এই বৈষম্য রয়ে গেছে। নেলসন ম্যান্ডেলা এমন একটা সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন সাদা চামড়ার মানুষদের ছিল আধিপত্য। বিপরীতে কালোদের প্রতি পদক্ষেপে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। তিনি এমন একটি দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেছেন যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে একসাথে থাকতে পারে। তার সারা জীবন তিনি এই আদর্শ নিয়েই লড়াই করে গেছেন। ইতিহাস তাকে তাই দিয়েছে রাজার আসন। স্কুলের এক শিক্ষক তার নাম রেখেছিলেন নেলসন। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাদিবা’। ম্যান্ডেলা সারা বিশ্বের গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতীক। ম্যান্ডেলা তার পরিবারের প্রথম সদস্য যে স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ম্যান্ডেলা রাজনীতিতে জড়িত হন তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সুবাদে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন ট্রান্সকেইয়ের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কাইজার  মাটানজিমা। এই বন্ধুর সুবাদেই পরবর্তীকালে ম্যান্ডেলা বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণে জড়িত হন। নেলসন ম্যান্ডেলা বরাবরই এই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ছিল। সক্রিয়ভাবে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যুক্ত হয়ে তিনি ১৯৫২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং মুক্তি সনদ প্রণয়ন করেন, যা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়। মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক দর্শনের প্রভাব ছিল তার ওপর। তিনি অহিংস নীতিতে বিশ্বাস করতেন। এভাবে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার ফলে তিনি শ্বেতাঙ্গবাদী সরকারের বিরাগভাজন হন এবং ১৯৫৬ সালে তাকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তার মুক্তির পর তিনি অহিংস আন্দোলন থেকে সরে এসে বর্ণবাদ সরকারকে হটাতে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা করেন।

তিনি জানতেন বর্ণবাদী সরকারকে হটাতে আর কোনো উপায় নেই। এএনসি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা করা হয়। এই দীর্ঘ কারাজীবন ম্যান্ডেলার জীবনের দুঃসহ সময়। তাকে নির্বাসন দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কুখ্যাত রুবেন দ্বীপে। তাকে কারাবন্দি করলেও বর্ণবাদ সরকার স্থির থাকতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতেই থাকে। কৃষ্ণাঙ্গ যুবকরা সেসব আন্দোলনে প্রাণ হারান। নেলসন ম্যান্ডেলাকে কারাবাস দেওয়ার পরপরই তাকে মুক্তির জন্য শ্বেতাঙ্গ সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এভাবে কেটে যায় ২৭ বছর। এই দীর্ঘ কারাভোগের পর ১৯৯০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কারাগার থেকে বেরিয়ে দেওয়া বক্তৃতায় ম্যান্ডেলা তার সমর্থকদের উদ্দেশে আবারো বলেন, তিনি সেই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সব জাতি, সব বর্ণের মানুষ সমান সুযোগ নিয়ে বসবাস করতে পারবে। অর্থাৎ তিনি একটি বৈষম্যহীন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন দেখতেন। কারাগারে কষ্ট সহ্য করাকালীনও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন।

মুক্তির পর ম্যান্ডেলার সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার চ্যালেঞ্জ। পুরনো দক্ষিণ আফ্রিকাকে নতুন করে বৈষম্যহীন করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। তিনি সাবেক শ্বেতাঙ্গদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন যারা একসময় তার ওপর হিংসাত্মক ব্যবহার করেছিল। এরপর ১৯৯৪ সালে আসে সেই সময় যেদিন দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষ তাদের প্রিয় নেতাকে বেছে নেয় তাদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। জনগণের বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচিত হন। তার রাজনৈতিক জীবনের মতো তার ব্যক্তিগত জীবনও ছিল ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তিনি তার সারা জীবনই নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। তাই অবসরে যাওয়ার পরেও তার এই ব্যস্ততা থামেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি চেষ্টা করেছেন মানুষের পাশে থাকতে। তিনি অবসরে যাওয়ার পর জনকল্যাণমূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার এক ছেলে এইডসে মারা যায়। তিনি এ ঘটনার পর চেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় এইডস প্রতিরোধ এবং এর চিকিৎসা নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে। তাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাকে কঅভাবে মনে রাখলে খুশি হবেন তিনি? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে।’

একজন মানুষ এবং তার প্রকৃত মূল্যায়ন সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি বলা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের প্রকৃত পরিচয় হয় কর্মে। নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন একজন চমৎকার মানুষ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, একজন ভালো বন্ধু এবং উদার মানুষ। তিনি একটি বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার এসব গুণ তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের এবং বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা উঠলেই নেলসন ম্যান্ডেলার নামটিই প্রথমে আসে।

 

লেখক : সাংবাদিক

sopnil.roy@gmail.com

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads