• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব

আশাবাদী হতে চায় দেশের মানুষ

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০২ আগস্ট ২০২১

মোহাম্মদ আবু নোমান                          

 

সম্পদের হিসাব দেয়া এবং নেয়া এই বিধান নতুন নয়। সরকারি কাজে ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হলে সম্পদের হিসাব নিতেই হবে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেয়া একটি বিধিবদ্ধ নিয়ম। সেই ঘোষণা এসেছে নতুনভাবে। অথচ আশ্রয়ণ প্রকল্পে দুর্নীতি, বালিশকাণ্ড, পর্দাকাণ্ড— এত কাণ্ড হওয়ার পরও ঘুম ভাঙেনি! এরকম আর কী কী নিয়ম মানা হচ্ছে না? এটা কি শুধু কর্মচারীদের জন্য, নাকি কর্মকর্তাদের জন্যও প্রযোজ্য? কেননা আমরা অনেক সময় দেখেছি শুধু ড্রাইভার অথবা তৃতীয়/চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাই ধরা পড়ে। বড় বড় কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তেই থাকে।

বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ঘুষ-দুর্নীতি একে অন্যের অনুষঙ্গ! হাতে গোনা দু/একজনের জন্য প্রযোজ্য না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ধ্রুবসত্য। সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেয়ার বিধান ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় তো আছেই। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত ২০১৮-এর সরকারি চাকরি আইনেও আছে। প্রশাসনের সবক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনরা যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও শুদ্ধাচারের কথা বলে আসছে, তা বাস্তবায়ন করতে হলে সম্পদের হিসাব নেয়ার বিকল্প নেই। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আওযয়ামী লীগ ক্ষমতায়। অথচ ইতঃপূর্বে নির্দেশনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের গরজও তেমন একটা দেখা যায়নি। যারা সম্পদের হিসাব নেবেন এবং হিসাব দেবেন, উভয়ই মনে হচ্ছে এতদিন কুম্ভকর্ণের ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। এতদিন বিধিমালা বাস্তবায়িত না হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বাস্তবায়িত হলে সরকারি অফিসগুলোতে যেমন শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত হতো, তেমনি দুর্নীতি কমতো। দেরিতে হলেও প্রতি পাঁচ বছর অন্তর চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দাখিল করার যে বিধান রয়েছে তা প্রতিপালনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা খুবই প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যের দাবিদার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই নির্দেশনা ও সরকারের উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।

গত ২৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে বলেছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর বিধি ১১, ১২ ও ১৩-তে সরকারি কর্মচারীদের স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রয় ও সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করতে উল্লিখিত বিধিগুলো কার্যকরভাবে কর্মকর্তাদের অনুসরণের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে জোর নির্দেশনা দিয়েছেন। চিঠির সঙ্গে সরকারি কর্মচারীর জমি বা বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা সম্পত্তি ক্রয় বা অর্জন ও বিক্রির অনুমতির জন্য আবেদনপত্রের নমুনা ফরম এবং বিদ্যমান সম্পদ বিবরণী দাখিলের ছকও পাঠানো হয়েছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠি কার্যকর করতে হলে আগে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের পরিপূর্ণ হিসাব নিয়ে মাঠে নামতে হবে। তারপর সরকারি কর্মকর্তাদের হিসাব কাজে আসবে। আমরাও আশাবাদী হতে পারবো। নয়তো সব ফাঁকা আওয়াজ হয়ে থাকবে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের আগে সংশ্লিষ্টদের পরিবারের (ভাই-বোনসহ) আর্থিক হিসাব, এমনকি ‘বড় কুটুম’ শ্বশুরবাড়ির (গোটা পরিবারের) আর্থিক অবস্থানের বিবরণ সংরক্ষণ করারও বিধান করতে হবে বলে আমরা মনে করি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েক লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া আছে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও অন্যরা। এ প্রেক্ষিতে আমরা বলতে চাই, কেবল সরকারি চাকরিজীবী নন, সরকারের নীতিনির্ধারক তথা মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদের হিসাবও নিতে হবে ।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, মন্ত্রী-সাংসদসহ সব জনপ্রতিনিধি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছাড়া কেউ জনসমক্ষে হিসাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এটি জনগণের কাছে দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এজন্য সরকারি চাকরিজীবীরাই নন, রাজনীতিবিদদেরও সম্পদের হিসাব নেয়ার সাথে সাথে জনগণের সামনে তা উন্মুক্ত করতে হবে। রাজনীতিবিদরা যেমন নির্বাচনের আগে জনগণের সেবক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন, তেমনি পুলিশ কিংবা অন্যান্য সরকারি কর্মচারী জনগণের সেবক হিসেবে গণিত হন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্বাহ হয়ে থাকে। এ কারণে নিয়োগদাতা শুধু সরকারের কাছেই নয়, জনগণের কাছেও তাদের জবাবদিহিতা করার বাধ্যবাধকতা আছে।

সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর নেয়ার পর দুর্নীতির কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত হলে পেনশন থেকে টাকা কেটে নেয়া যেত। কারো কোনো দুর্নীতি থাকলে বা তার কারণে সরকারের যদি কোনো লস হয়ে থাকে, তাহলে আগের আইনে তার পেনশন থেকে পুরোটা বা কিছুটা কেটে নেওয়ার বিধান ছিল। এটা যাতে না থাকে, অর্থাৎ অপরাধ থেকে দায়মুক্তির জন্য জনপ্রশাসন থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু গত ২৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভা বৈঠকে সরকারি চাকরি (সংশোধন) আইন, ২০২১-এর খসড়া উপস্থাপন করা হলে তাতে সম্মতি দেয়া হয়নি। মন্ত্রিসভা আগেরটাই রেখে দিয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীরা নিজ চেয়ারে থেকে ক্ষমতার দাপটে যেসব অন্যায়, অবিচার, অসদাচরণ করেছেন তা থেকে কীভাবে তারা দায়মুক্তির প্রস্তাবনা করতে পারেন তা আমরা বুঝতে পারি না। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সবাইকে ধন্যবাদ, দায়মুক্তির প্রস্তাবনা পাস না করার জন্য ।

বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকার থেকে ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিনিময়ে সরকার এবং জনগণও তাদের কাছ থেকে সঠিক সেবা পাওয়ার আশা করেন। কিন্তু সরকারি অফিসের কেরানি থেকে অফিসার পর্যন্ত অসহিষ্ণু আচরণ করে থাকেন তা ভুক্তবোগী মাত্রেই জানেন। এতে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের ভোগান্তি, তেমনি সরকারেরও ক্ষতি হয় বিভিন্নভাবে। এমনকি কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তার হতাশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা বেশি বেতন পাচ্ছেন কিন্তু আরও ভালো কাজ করার জন্য নিজেকে দায়বদ্ধ বোধ করছেন না।’ সচিবালয়সহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সরকারি অফিসেও কর্তব্যরতদের যথাসময়ে খুঁজে পাওয়া দায়। আবার একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে দেরিতে আসার পরও কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঊর্ধ্বতন কর্তাদের ম্যানেজ করে অফিস শেষ হওয়ার আগে বাসায় চলে যান। বিশেষ করে উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালসহ সরকারি বিভিন্ন অফিসে কর্মচারীদের অনুপস্থিতি যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি কোনো বিরাগ বা বিদ্বেষ থেকে নয়, প্রশ্ন হলো— সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এতো সুযোগ-সুবিধার পরও বাংলাদেশে সরকারি এমন কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কি, যেখানে জনগণ ঘুষ, অনিয়ম বা হয়রানি ছাড়া সেবা পাচ্ছে?

বেসরকারি চাকুরেরা যদি স্বল্প বেতনে ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া চলতে পারেন, তাহলে সরকারি চাকরিজীবীরা কেন পারছেন না? সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করায় কারো অখুশি বা নিরানন্দের কারণ নেই। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালনে কতটা নীতি ও নৈতিকতার পরিচয় দিতে পারবেন তা প্রশাসনের স্বচ্ছতা, শুদ্ধতাই বলে দেবে। একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান সরকারি চাকরিজীবী অর্থনৈতিক দিকটার নির্ভরতার পর যদি সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায়নীতির সঙ্গে কাজ করেন, তাহলে দেশের সব পর্যায়ে ব্যাপক উন্নয়নসহ সুজলা-সুফলা এই দেশ সোনার দেশে পরিণত হওয়া সম্ভব। অল্প সময়েই পাল্টে যেতে পারে দেশের চেহারা।

একথা ঠিক যে, সবাই দুর্নীতিবাজ নন। এটাও ঠিক যে, ঘুষখোরদের কর্মকাণ্ড তাদের উপরের অফিসারদের প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘এ দেশে ঘুষছাড়া কিছু হয় না,’ এ ধরনের কথা বহুবারই বলেছেন। এছাড়া ‘কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না’ মর্মে শেখ হাসিনা যে মন্তব্য করেছেন, তার মধ্যেই মূলত সর্বব্যাপী জবাবদিহিতার গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। ছাত্রলীগের ঘটনা ও ক্যাসিনো পরিস্থিতির পর প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার কারণে তার জনপ্রিয়তা আরও অনেক বেড়ে গেছে। আস্থা এবং ভরসার জায়গায় প্রধানমন্ত্রী অনেক ওপরে চলে গেছেন। এর আগে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ যে ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং সম্প্রতি দলীয় পরিচয় ও পদের অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে তার কঠোর ও অনমনীয় অবস্থান যথাযথভাবে পরিপালন হলেই কেবল প্রত্যাশিত সুফল পাওয়া যাবে বলে আমরা মনে করি।

 

লেখক : গণমাধ্যকর্মী

www.nobosongbad.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads