• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

বাঙালির মণিকোঠায় সমুজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ১৪ আগস্ট ২০২১

বিশ্বাস এবং বিশ্বাস ভঙ্গের ইতিহাস বাংলার বুকে নতুন ঘটনা নয়। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সাথে ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা মীরজাফর আলী খান, তার খালা ঘসেটি বেগম এবং এদেশীয় বণিকগোষ্ঠী যারা নবাবের কাছ থেকে সব রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল এবং তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই পলাশীর প্রান্তরে নবাবকে পরাজয় বরণ করতে হয় এবং তারপর তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আর একটি বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট। ইতিহাসের নৃশংসতম একটি ঘটনা, যা বাংলার বুকে কালিমা লেপন করেছিল। সদ্য স্বাধীন হয়ে একটু একটু করে এগিয়ে চলা দেশকে থামিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করা হয়েছিল। আগস্ট মাস এলেই বাঙালির হূদয়ে এক ধরনের শূন্যতা অনুভূত হয়। এ শূন্যতা জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। তাকে হারানোর সেই বেদনা আজো বাঙালির অন্তরে বিদ্যমান। আমরা হারিয়েছি সেই মানুষটিকে যে আমাদের নিয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন, আমাদের জন্যই বুক পেতে বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, আমাদের ভালোবেসেই অন্ধকার কারাগার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছিলেন জীবনের অধিকাংশ সময়। তিনি ছিলেন বিশ্বের এক মহান নেতা, জাতির প্রকৃত কান্ডারি। এ মাসেই আমরা তাকে হারিয়েছি। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এ নিয়ে সতর্কও করা হয়েছিল। কিন্তু হিমালয়সম হূদয়ের অধিকারী এই মানুষটি তা বিশ্বাস করতে চাননি। এই বাংলারই মানুষ যাদের তিনি আপন করে নিয়েছেন, তারাই তার ও তার পরিবারের ক্ষতি করতে পারে এ ছিল অবিশ্বাস্য।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে যে নিষ্ঠুর বর্বর হত্যাকাণ্ড হয় পৃথিবীতে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের মতো নির্মম ইতিহাস আর নেই। যেখানে বাঙালির প্রাণপুরুষকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি হায়েনার দল, সেদিন সেখানে উপস্থিত সবাইকেই এই নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছিল। ছোট্ট দুধের শিশুও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর করতে হাত কেঁপেছিল তা করতে এদেশেরই কিছু কুসন্তানের হাত কাঁপেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তো গণতন্ত্র হত্যার দীর্ঘ ইতিহাস এ দেশের বুকে। গণতন্ত্র ফিরতে অনেক সময় নিয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল আরো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে কী চেয়েছিল নরপশুর দল? দেশকে থামিয়ে দিতে? তা কি ওরা আদৌ পারত? ওরা ভুলে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু কেবল ধানমন্ডির সেই বাড়িতেই থাকেন না, তিনি বাঙালির অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছেন। যার বাস প্রতিটি মানুষের হূদয়ে, তাকে শেষ করা অসম্ভব। এই প্রকৃত সত্যটি সেদিন অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল সেই খুনির দল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মানবতা ও মহত্ত্বের অনন্য উদাহরণ এবং আদর্শ, ত্যাগ, ক্ষমার সুমহান বন্ধু। সেদিন কেঁদেছিল বাংলার মানুষ, এই নিষ্ঠুরতা দেখে বিশ্বও অবাক হয়েছিল। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তীসময়ে তিনি প্রায় শূন্য হাতে দেশ গড়ার কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়তে। বিশ্বাসঘাতকের বুলেটে তার বুক ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পূর্ব পর্যন্তও তিনি এদেশের মানুষের জন্যই ভেবেছেন। তিনি চেয়েছিলেন সব ধরনের প্রতিকূল অবস্থা থেকে এদেশের মানুষকে মুক্তি দিতে। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় তিনি পেয়েছিলেন তার স্বপ্নপূরণের জন্য। তারপরই তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এত কম সময়েও তিনি এ জাতিকে একটি আত্মর্যাদাসম্পন্ন জাতিতে পরিণত করে যান।

আজ যে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আমরা দেখছি তার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে এদেশ যাতে কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই লক্ষ্যে দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। সেইসাথে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয় এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে নানারকম টালবাহানা করেছে। তাদের কোনো ইচ্ছাই ছিল না পূর্ব পাকিস্তান কোনোভাবে সমৃদ্ধ হোক। এদেশের সম্পদের প্রতিই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শ্যেন দৃষ্টি। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল স্পষ্ট বৈষম্য। পূর্ববাংলায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠলেও তার সুফল ভোগ করত পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর সেসব পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানা ফেলে চলে যায়, যা ১৯৭২ সালে এক আইনে ৪০০টি ব্যাংক, বীমা, পাট ও বস্ত্রকল জাতীয়করণ করেন বঙ্গবন্ধু। এদেশের পূর্ববাংলার মানুষ এই বৈষম্য মেনে নিতে পারেনি। নিজেদের স্বকীয়তার প্রতি সব সময়ই বাঙালি ঐক্যবদ্ধ ছিল। বুকে ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাঙালির সেই স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশের মাটিতে পা রাখেন। বাঙালি ফিরে পায় তাদের স্বপ্নের মানুষকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক সদ্য জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রটি ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়ে যাত্রা শুরু করে। পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পায়।

সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে প্রাথমিক সংকট ঠিকই কাটিয়ে ওঠে এদেশ। বাংলাদেশের প্রাথমিক সংকট কাটিয়ে উঠতে ভারতের কাছ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পায়। এছাড়া সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব দিয়ে কেবল এদেশের মানুষের মনই জয় করেননি, বিশ্বের বড় বড় নেতারাও তাকে ভালোবাসত, শ্রদ্ধ করত। তাদের মনেও বঙ্গবন্ধুর জন্য এক প্রগাঢ় ভালোবাসা ছিল। দেশের অর্থনীতি নতুন করে গড়ে তুলতে ১৯৭৩ সালে প্রথম পাঁচসালা বা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন বঙ্গবন্ধু। দারিদ্র্য দূর করা, সবার জন্য মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করা এবং কৃষির আধুনিকায়ন করার মাধ্যমে উৎপদন বৃদ্ধি করা এসব ছিল প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। দেশ গঠনে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে বিশ্ব শান্তি পরিষদ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মাধ্যমে তার জীবন্ত সত্তাকে থামিয়ে দেওয়া গেছে, তবে থামানো যায়নি তার দেখা স্বপ্নকে। তিনি তার কর্মের বিশাল অর্জনের মাধ্যমে, তার মহত্ত্বের মাধমে ব্যক্তিসত্তার চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। তা বুঝতে খুনি চক্রের বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাই সাময়িকভাবে দেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিলেও বাংলাদেশ আজ ঠিকই উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তিনি তো প্রতিটি মানুষের মুখে আহার তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সেই স্বপ্নপূরণেই দেশ এগিয়ে চলেছে।

শত্রুরা মনে করেছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেই সব শেষ হয়ে যাবে; তারা ভাবেনি এমন একজন মানুষকে হত্যা করে তার মহত্ত্বকে শেষ করা যায় না। আজ বঙ্গবন্ধু কবির কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, গানে এবং সর্বোপরি মানুষের মনে। বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথম দেখায় কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতার দিক থেকে এই মানুষটি হিমালয়। তাই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা পেলাম।’ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ এবং অনন্য উচ্চতার। হিমালয়ও যেন তার কাছে হার মানে। আবার বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবরের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল বন্ধুকে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন সময় উচ্চারণ করা কথাগুলোই যেন অমর বাণী। তার কণ্ঠে বিভিন্ন সময় দেশের গণতন্ত্র, বৈষম্য, অসাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও সহনশীলতা, দুর্নীতিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। সে কথাগুলো যেন চিরকালের এবং কালোত্তীর্ণ। কোনো জেল, বন্দুক, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুই তাকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মানুষের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য আজীবন লড়াই করে গেছেন। যুদ্ধ পরবর্তীসময়েও তিনি বাংলার মানুষকে ভালোবেসে তাদের ভালো রাখার জন্য প্রতিটি সময় কাটিয়েছেন। আজ বাংলাদেশ এক অদম্য বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মানবতার জননী আমাদের মমতামীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ শিখর পানে চলেছে। বঙ্গবন্ধু আজ নেই তবে তার স্বপ্ন আছে। আজকের তরুণদের চোখেও সেই সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখতে চাই, বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতে চাই।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads