• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মাস্ক ব্যবহারে অবহেলা নয়

  • প্রকাশিত ১৬ আগস্ট ২০২১

শাহীন চৌধুরী ডলি

 

বাংলাদেশে প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। গত একমাসে মৃত্যুর পরিসংখ্যান রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। যে কারণে টিকা কেন্দ্র, নমুনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে প্রতিদিন। করোনা নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই। করোনা থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করার এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। জীবাণুর ব্যবহার কমাতে মাস্কের ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি দেশে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

করোনার ঢেউ থামাতে সঠিক নিয়মে মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের আক্রমণ কমাতে মাস্ক পরার অভ্যাস অব্যাহত রাখতে হবে। সরকার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে অফিস-আদালতে। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরার নির্দেশ দিয়েছে সরকার ও প্রশাসন। সরকারি এ নির্দেশ মানছেন না দেশের অধিকাংশ নর-নারী। শহর এলাকায়, বাজারে, মার্কেটে, পথে-ঘাটে সাধারণ জনগণ মাস্ক পরতে দেখা গেলেও গ্রামে-গঞ্জে এ নিয়ে সচেতনতা কম। গ্রামের চায়ের দোকানে, হাটে-বাজারে অধিকাংশ মানুষকে এখনো মাস্ক পরতে দেখা যাচ্ছে না।

মাস্ক পরানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে। যারা মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হচ্ছে তাদের জন্য জরিমানা করার বিধান রয়েছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাইকে মাস্ক পরাতে নানা উদ্যোগের পরেও মাস্ক ছাড়াই ঘরের বাইরে যাচ্ছে মানুষ। তবে কেউ মুখে মাস্ক ব্যবহার না করলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি করা হচ্ছে। মাস্ক পরতে বাধ্য করার চলমান অভিযানগুলোতে দেখা গেছে ম্যাজিস্ট্রেট দেখলেই অনেকে মুখে মাস্ক পরছেন। অন্যসময় মাস্ক পকেটে ঢুকিয়ে রাখছেন। শুধু জরিমানা বা শাস্তির ভয়ে মাস্ক পরলে করোনার সংক্রমণ ঠেকানো কঠিন হবে। জরিমানা নয়, করোনা সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। অনেকের নিয়মিত মাস্ক কেনার সামর্থ্য নেই— এটা ঠিক কথা। আর এজন্য দেশে চলমান অভিযানে সামর্থ্যবানদেরই জরিমানা করা হচ্ছে। যাদের সামর্থ্য নেই তাদের সরকারের পক্ষ থেকে মাস্ক পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অনেককেই অবহেলা করে মাস্ক না পরে জনবহুল এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। এটা স্বাস্থ্যবিধির সম্পূর্ণ লঙ্ঘন যা নিজেকে এবং অন্যদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলছে। অনেকেই মাস্ক না পরার বিভিন্ন অজুহাত দেখান, যার কোনো যথার্থতা নেই। সামর্থ্যবান লোকজন মাত্র ৪-৫ টাকা মূল্যের মাস্ক কিনে পরতে পারেন না এমন নয়, অবহেলা করে দেশকে করোনার মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছেন তারা। নিজের ও অপরের সুস্থতার জন্য সকলের মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। আমাদের দেশে করোনা নিয়ে অজ্ঞতা বর্তমানে নেই বললেই চলে। যেভাবে দেশ-বিদেশের প্রচার মাধ্যমে করোনা বিষয়ে সতর্কতা সূচক প্রচার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তাতে কেউ করোনা মহামারি সম্পর্কে না জানার কথা নয়। মাস্ক না পরে সামান্য অবহেলার জন্য নিজে এবং অন্যের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কারণ ঠিক হবে না। তাছাড়া নিজের মধ্যে করোনা সংক্রমণ থাকলে মাস্ক না পরে অন্যজনকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ঠেলে দেয়া হবে খুব অমানবিক কাজ।

প্রাথমিকভাবে সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মাস্ক ব্যবহার করতে পরামর্শ দেয়নি। মাস্ক শুধু হাঁচি, কাশি, জ্বরের রোগীদের এবং যারা এসব রোগীর স্বাস্থ্যসেবার সাথে নিয়োজিত আছেন, তাদের ব্যবহার করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই মুহূর্তে গরম, ঝড়, বৃষ্টি আর বাতাসে প্রচুর ধুলো-বালি। আর ধুলো-বালি, ঠান্ডা-সর্দিজনিত রোগের কারণ। তাই এখন মাস্ক শুধু করোনা থেকে রক্ষা করবে না, অন্যান্য বায়ুদূষণ জনিত রোগ থেকেও রক্ষা করবে। তাই সবার জন্যই মাস্ক পরা জরুরি। বর্তমানে সরকারি নীতি হচ্ছে, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’। অর্থাৎ কোনো পাবলিক প্লেসেই মাস্ক ছাড়া যাওয়া নিষেধ।

করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে বারবার মানুষকে সচেতন থাকার নির্দেশ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং সামাজিক দূরত্ববিধি মেনে চলার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে বারবার। টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে এবং দেশে দেশে টিকা দেয়ার কার্যক্রম চলছে। টিকা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বের ধনী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে দরিদ্র দেশের জনগণ। সিডিসি-র (Centers for Disease Control and Prevention) এক বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কেবল প্রতিষেধক নেওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের সময় মাস্ক পরিধান অগ্রাহ্য করতে পারেন। কিন্তু যখন বড় কোনো জমায়েতের মধ্যে যেতে হবে, যেখানে প্রত্যেকে প্রতিষেধক নিয়েছেন কিনা তা নিশ্চিত নয়, তখন মাস্ক ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে।

মহামারির আতঙ্কের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির এই শিথিলতা মানুষকে অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস এনে দিয়েছে। যদিও ভারত-বাংলাদেশের মতন দেশে এটুকু শিথিলতার সময় এখনও আসেনি, কারণ আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশেরও কম মানুষ টিকা পেয়েছে। বাড়ির বাইরে পা রাখলে যতজন মানুষের মুখোমুখি হতে হবে, তাদের বেশিরভাগই টিকা নেওয়া হয়নি। ফলে টিকা নেওয়া হলেও মাস্কের প্রতি অবহেলা করা যাবে না। কিছুদিন আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশে টিকা প্রক্রিয়া অনেকটাই অসফল। কোথাও কোথাও একেবারেই শুরু হয়নি প্রতিষেধক দেওয়া। তাই মহামারির আতঙ্ক পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে ঢের দেরি। আর এ সময় মানুষকে সচেতন থাকতেই হবে।

টিকা নেওয়া হলেও মাস্কের ব্যবহার এবং অনান্য স্বাস্থ্যবিধির ব্যাপারে অবহেলা করা যাবে না। টিকা নেওয়ার পরেও করোনার শিকার হয়েছেন অনেকে। বেশ কিছু তথ্য থেকে চিকিৎসকরা একথাই বলছেন, টিকা নিলেও করোনা আতংক থেকে মুক্তির উপায় নেই। আবার সবধরনের টিকার কার্যকারিতা সমান নয়। মডার্নার টিকা ৯০-৯৪ শতাংশ কার্যকর। ফাইজার কোম্পানির টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। কোভিশিল্ডের কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ। কোভ্যাক্সিনের কার্যকারিতা আরও কম, মাত্র ৮০ শতাংশ। ফলে প্রতিষেধক নেওয়ার পরেও বহু মানুষের আক্রান্তের ভয় থেকে যায়। আর এই সময়টাই ভাইরাস মোকাবিলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। তার জন্য শুধু প্রয়োজন মানুষের সতর্কতা। টিকা এসে গিয়েছে ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলে বিপদ ঘটবে, তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিন এখনও শেষ হয়নি। সবার কাছে সেই আবেদন রাখছেন চিকিৎসকরা।

অনেকের ভেতরে একটা প্রশ্ন কাজ করে, একটির পরিবর্তে দুটি মাস্কের ব্যবহার কি বেশি সুরক্ষা দিতে পারবে? অনেকের মন্তব্য, একটির পরিবর্তে দুটি মাস্কের ব্যবহার চাপ সৃষ্টি করতে পারে মানুষের শ্বাস প্রক্রিয়ায়। এবার সে ব্যাপারে পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকরা। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে, একইসাথে দুটি মাস্কের ব্যবহার মানুষের শ্বাস প্রক্রিয়ায় চাপ ফেলবে, একেবারেই সেই আশঙ্কা নেই। বরং দুটি মাস্কের ব্যবহার অধিকতর নিরাপত্তা দেবে মরণ ভাইরাস সংক্রমণ থেকে।

চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, দুটি মাস্কের ব্যবহার প্রায় ৯৬ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে ভাইরাসের আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনাকে। শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির থেকেই সুরক্ষা প্রদান নয়, আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির ডাবল মাস্ক ব্যবহারে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াও আটকানো যেতে পারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। প্রথমত মাস্কের বাইরের স্তর ভেদ করে ওয়াটার ড্রপলেটের পরিস্রাবণ ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। পাশাপাশি ডাবল মাস্কিংয়ের ফলে বাইরের মাস্কটির চাপে ভেতরের মাস্কের প্রান্তভাগ চেপে বসে যায় ত্বকের সঙ্গে। ফলে মাস্কের ফাঁক দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে না। আর সে কারণে ট্রেন স্টেশন, বাস, এয়ারপোর্টের মতো যেকোনো জনবহুল এলাকায় দুটি মাস্ক পরার জন্য অনুরোধ করেছেন সংক্রামক বিশেষজ্ঞরা। একথাও ঠিক যে, ডাবল মাস্কিংয়ের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হচ্ছে কারো কারো। তবে সেক্ষেত্রে দুটি কাপড়ের মাস্ক বা একটি সার্জিক্যাল মাস্কের ওপর কাপড়ের মাস্কের ব্যবহার অনেকটা স্বস্তি দিতে পারে। আর একান্তই যদি ডাবল মাস্কিংয়ের ব্যবহার সম্ভব না হয়, তাহলে এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে আপাতত ডাবল মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা প্রতিরোধে মাস্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাইরে গেলে কখনো নাকে, মুখে হাত দেওয়া যাবে না। বারবার নিজের চোখ-নাক-মুখে, হাত লাগানোকে অপরাধ হিসেবে মনে করতে হবে। প্রয়োজন না হলে মাস্ক খোলা যাবে না। কোনো লোকের হাঁচি-কাশি থাকলে, তাকে মাস্ক পরতে বলতে হবে এবং তার থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। নিজের যদি হাঁচি-কাশি পায়, হাতের কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচি বা কাশি দিতে হবে অথবা টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ ঢেকে হাঁচি বা কাশি দিয়ে ঢাকনা লাগানো বিনে ফেলে দিয়ে দ্রুত সাবান পানিতে হাত ধুয়ে নিতে হবে। নিজের বা পরিবারের কোনো সদস্যের যদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকে বা এমন কোনো অক্ষমতা থাকে যার কারণে মাস্ক ব্যবহার করা কঠিন হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে কী করা সবচেয়ে ভালো হবে সে বিষয়ে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

শরীরচর্চার সময় এমন স্থান বাছাই করতে হবে যেখানে মাস্ক পরার প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে ঘর বা বাইরের এমন কোনো স্থান বাছাই করতে হবে যেখানে নিজেকে অন্যদের থেকে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব। শিশু এবং বয়স্কদের খেলাধুলা বা শারীরিক কার্যকলাপের সময় মাস্ক পরা উচিত নয়, যাতে এটি তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে কোনো ধরনের সমস্যা তৈরি করতে না পারে। ঘাম মাস্ককে ভিজিয়ে ফেলতে পারে, যা নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা তৈরি করবে এবং জীবাণুর বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

মাস্ক পরার জন্য প্রথম থেকেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে দেশের সব জেলায় জেলা প্রশাসনের পক্ষে প্রচার প্রচারণাসহ মাইকিং, লিফলেট ও মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। যারা মাস্ক না পরে ঘরের বাইরে বের হচ্ছেন, সচেতনতা বাড়াতে তাদের আটক, জরিমানার মতো অভিযান অব্যাহত আছে। সামর্থ্যহীন ব্যক্তির বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এ সমস্যা থাকবে না। সবার ভেতর যেন মাস্ক নিয়ে সচেতনতা তৈরি হয় এমন ক্যাম্পেইন চালিয়ে যেতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, কেবল একটি মাস্ক কোভিড-১৯-এর বিস্তারকে আটকাতে পারবে না। আমাদের সবাইকে মাস্ক পরিধান করার পাশাপাশি শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা এবং ঘন ঘন হাত ধোয়ার চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। একইসঙ্গে এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা কোভিড-১৯ পরাহত করতে পারবো।

 

লেখক : মুক্তগদ্য লেখক

shaheen.babu1971@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads