• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

অবশেষে খুলতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ছোবলে শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। যদিও আমাদের দেশের ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তুলনামূলক শিক্ষার ক্ষতি বেশিই হয়েছে। কারণ গত বছরের মার্চে কোভিড-১৯ প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর দ্রুত বন্ধ হতে থাকে প্রাইমারি থেকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১ বছর ৫ মাস। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর খোলা সম্ভব হয়নি। যদিও দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত মাঝেমধ্যে খুললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার এখনো বন্ধই রয়েছে। অথচ শিক্ষা অর্জনের বাতিঘর হিসেবে খ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ ব্যবস্থা সেই অনেকদিনের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিক্ষা অর্জন করা আদৌ সম্ভব নয়। সে অর্থে অপূরণীয় এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দ্বার খুলে দিয়ে নির্বিঘ্নে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার ওপর জোর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। অতিসম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু তহবিলের ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা মহামারিতে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি শিক্ষার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। যেন শিক্ষাবিদদের পরামর্শ গ্রহণ করে সরকার শিক্ষার ক্ষতি পোষাবার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

যদিও শিক্ষার কার্যক্রম চালু রাখতে সরকার অনলাইনভিত্তিক পাঠদান কার্যক্রমও চালু রেখেছে; কিন্তু আমাদের দেশে আর্থসামাজিক অবস্থা, শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ বাসাবাড়িতে না থাকায় প্রায় ৯০ শতাংশের ওপর শিক্ষার্থী এ পথে কোনো শিক্ষা অর্জন করতে পারেনি। যে কারণে গোটা দেশজুড়েই সর্বস্তরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক নানাভাবে আন্দোলন করলেও সংক্রমণ বৃদ্ধির ভয়ে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়নি। ফলে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি। সর্বশেষ সরকার আগামী ১১ সেপ্টম্বর পর্যন্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বর্ধিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সাথে সাথে ঘোষণা করেছে মধ্য সেপ্টম্বর থেকে পর্যায়ক্রমে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হবে। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ সেপ্টেম্বরে খুলে না দিলেও হয়তো অক্টোবর থেকে খুলে দেওয়া হতে পারে। মনে হচ্ছে, সরকার এ দফায় যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা হয়তো কার্যকর হবে। কারণ ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডব্লিউএফও জানিয়েছে, বিশ্বে বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কমেছে। আবার এটাও ঠিক, বিশ্বের ধনী দেশগুলোয় অধিকাংশ মানুষ ভ্যাকসিন গ্রহণ করায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আর আমাদের দেশে তো ভ্যাকসিন গ্রহণকারীর সংখ্যা নগণ্যই। যদিও এখন মানুষের টিকা গ্রহণে আগ্রহ বেড়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে হারে সরকার ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে ভ্যাকসিন কার্যক্রমও থেমে থেমেই প্রয়োগ হচ্ছে। যদিও সরকার গোটা দুনিয়ার নানা দেশ থেকে ভ্যাকসিন কিনতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু তৎপরতার তুলনায় সফলতা নমুনা খুব যে বেশি নয়, তা বলাই যায়।

কথায় আছে-‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান’। ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পর থেকে সরকার শুধু দুই-একটি দেশকেন্দ্রিক ভ্যাকসিন সংগ্রহে নির্ভরশীল না হয়ে বর্তমানে যেভাবে দৌড়ঝাঁপ করছে, তা করলে হয়তো ভ্যাকসিন সংকট এত হতো না। অবশ্য বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকার দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তা যথার্থই। একমাত্র দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদন করে সকল স্তরের মানুষকে শতভাগ ভ্যাকসিনের আওতায় আনা সম্ভব। কারণ সকলকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে না পারলে যদি কোনো কারণে আর একবার করোনার ঢেউ আঘাত হানে, তাহলে যে মহামারি হবে, তা কল্পনার সীমাকেও অতিক্রম করতে পারে। যে কারণে এখন ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও নিজেদের দেশে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে, যার কোনো বিকল্প নেই।

বিশেষ করে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে শিথিলতা কোনোভাবেই উদাসীন হওয়া যাবে না। পর্যাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে প্রতি শ্রেণিকক্ষে ন্যূনতম তিন ফুট দূরত্বে বসা এবং মুখে মাস্ক ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সকল শিক্ষার্থীকে হাত ধোয়ার নিয়ম পালনে উৎসাহ দিতে হবে। শুরুতেই করোনা কী? এর ব্যাপকতা গোটা দুনিয়ায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, আর্থসামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সর্বোপরি সীমাহীন দুর্ভোগের ওপর বিস্তারিত গঠনমূলক আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে হবে। কারণ শতভাগ ভ্যাকসিন প্রয়োগ এবং বুস্টার ডোজ না দেওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। একমাত্র আগে জীবন, তারপর জীবিকা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি। সবদিক বিবেচনায় নিলে অন্তত ৮০ ভাগ ভ্যাকসিন প্রয়োগ ছাড়াই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মধ্যে যে ঝুঁকি আছে, তা সকলে স্বীকার করলেও দাবি তুলছে, যেহেতু জীবিকার তাগিদে কম-বেশি এখন সবই খুলে দেওয়া হচ্ছে, সেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খুলে দেওয়া হোক। এ দাবির যে যথার্থতাও আছে, তাও স্বীকার করতে হবে। সবই যদি চালু থাকে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে কেন? সরকারও এমনভাবেই ভাবছে, এতে সন্দেহ নেই। সরকার তো প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পরও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনভাতা দিয়েছে। তাহলে সরকারও অহেতুক বেতন-ভাতার পেছনে টাকা খরচের ব্যাপারে যে উৎসাহি, তাও না। বাস্তবতা হচ্ছে, পরিস্থিতি এসব করতে বাধ্য করেছে।

যে নির্মমতার চিত্র বিশ্ববাসী দেখেছে, তা যে কত নির্মম ও হূদয়স্পর্শী তা কার অজানা আছে? করোনার তীব্রতার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর চারদিকে শুধু নেই নেই চিত্র। হাসপাতালে বেড নেই, আইসিসিইউ নেই, অক্সিজেন নেই। চোখের সামনে কত আপনজনকে বিদায় নিতে হচ্ছে। অথচ ছোঁয়া যাবে না। যেন মৃত্যুদূত সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কারণ স্পর্শ করলেই সে আক্রান্ত হতে পারে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর এ যন্ত্রণার শিকার কেউই হতে চান না। ফলে অতি আপনজনকেও কাফনে-দাফনে, চিতায় নিতে হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক দলকে। হায়রে জীবন, মৃত্যুকালেও অনেকের ভাগ্যে আপনজনকে দেখার সুযোগ জোটেনি! দেখলেও দূর থেকে বিদায় জানাতে হয়েছে। হাসপাতালে মা আইসিসিইউতে ভর্তি। মায়ের বুকের ধন ছেলে করোনায় মৃত্যুমুখী। হাসপাতালে আইসিসিইউ নেই। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মা আইসিসিইউ ছেলের জীবন বাঁচাতে ছেড়ে দিয়েছে। তবে করুণাময়ী মায়ের জীবন আর রক্ষা হয়নি। মাকে চলে যেতে হয়েছে না-ফেরার দেশে। নির্মমতার এমনি অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে দেশে-বিদেশে, যা এখনো চলমান রয়েছে। আমরা চাই না, এ নির্মমতার শিকার হয়ে আর কাউকে যেন মৃত্যুবরণ করতে না হয়। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই একমাত্র নিরাপদ অবলম্বন।

মোদ্দাকথা, বৈশ্বিক মহামারি করোনার আগ্রাসন বন্ধ করতে হলে সকলের টিকা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। যে কারণে দেশেই টিকা উৎপাদনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ইনসেপ্টা ও সিনোফার্মের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। আশা করি, এই টিকা উৎপাদন শুরু হলে গণটিকা গ্রহণ কর্মসূচিকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার স্বার্থে আপাতত শিক্ষক, কর্মচারী, শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় যতদূর সম্ভব আনতে হবে। যদিও করোনাকালীন সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডও রয়েছে। সে মানদণ্ডে বলা হয়েছে, সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের মধ্যে থাকতে হবে। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার স্বার্থে টেকনিক্যাল কমিটি তা ৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে ১০ শতাংশের নিচে থাকাকে বাঞ্ছনীয় মনে করছে। সবদিক বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের আবহাওয়া, পারিবারিক রীতিনীতি ও শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার শর্তে হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকার ঘোষিত সময়ে খুলে দিলে হয়তো শিক্ষার ক্ষেত্রে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তাকে অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আমরাও মনে করি, শিক্ষা সংক্রান্ত পরামর্শ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করাই সঠিক ও সময়োচিত হবে।

 

লেখক : সমাজ বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads