• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

মাইক্রোমার্কেটিং

অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য মার্কেটিং কৌশল

  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০২১

ড. মীজানুর রহমান

 

প্রায় পুরো বাজার দেশীয় এবং বহুজাতিক বড় কোম্পানির দখলে যাওয়ার পরও অন্তত ১০% বাজার অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে থেকে যায়। আমাদের দেশে কোন কোন পণ্যের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাজার এখনো অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখলে রয়ে গেছে। এদের মার্কেট নিচার বলা হয়। বাজার নেতা (৪০%), মার্কেট চ্যালেঞ্জার (৩০%) এবং অনুসারীদের (২০%) দখল নেওয়ার পরও বাজারের কিছু অংশ থেকে যায়, যা উপরোক্ত বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষে দখলে নেওয়া সম্ভব নয়। অন্তত ১০% কাস্টমার কোনো অবস্থাতেই বাজারে প্রচলিত পণ্য বা সেবা দিয়ে সন্তুষ্ট হবে না। তাদের চাই বিশেষ পণ্য যেটা একান্তভাবেই তাদের জন্য আলাদা করে সরবরাহ করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটিকে মাইক্রোমার্কেটিং বলা হয়।

বিষয়টিকে স্পষ্টতর করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কোকা কোলা, পেপসি কোলা, আরসি কোলা, ইউরো কোলা, ভার্জিন কোলা,মক্কা কোলা ইত্যাদি প্রায় পঞ্চাশটির মতো পরিচিত কোমল পানীয় বাজারে থাকার পরও কিছু লোক পাওয়া যাবে তারা এর কোনোটা পান করেই সন্তুষ্ট নয়। নিয়মিত ইনসুলিন নেয় এমন পরিচিত একজনকে বলতে শুনেছি বাজারে যদি একটা করলা কোলা পাওয়া যেত! কারণ ডায়াবেটিসের জন্য সে কোনো কোলাই খেতে পারে না। অতএব তার জন্য সবচেয়ে ভালো হতো যদি করলা কোলা বাজারে পাওয়া যেত। কারণ তাকে নিয়মিত করলার রস খাওয়ার জন্য ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে, এতে নাকি রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটা কোনো বড় কোম্পানির পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। সেজন্য ছোট একটি ফার্ম একান্তই স্বল্প পরিসরে শুরু করতে পারে। প্রথমেই ব্যাপক স্থাপনা, যন্ত্রপাতি এবং লোকজন নিয়ে শুরু করার প্রয়োজন নেই। কেবল একটি ভ্যানগাড়ি লাগবে, যাতে একটি জুসার মেশিন থাকবে আর একেবারে তাজা কিছু করলা থাকবে। বারডেম হাসপাতাল সংলগ্ন কোনো এক জায়গায় সে তার ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে এবং ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবে করলার জুস বানিয়ে আগ্রহীদের মধ্যে পরিবেশন করবে। আমার ধারণা প্রথম দু-একদিন একটু সমস্যা হলেও কয়েকদিনের মধ্যে প্রচারণা পেয়ে যাবে এবং আস্তে আস্তে করলার জুসের কাস্টমার বাড়তে থাকবে।

প্রায় প্রত্যেক শিল্পে কিছু ফার্ম থাকে যারা বিশেষ একটি খণ্ডাংশ বা ফোকরকে বাজারজাতকরণ সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিশিষ্টতা অর্জন করে। পুরো বাজার বা বড় বাজার বিভাগের দিকে হাত না বাড়িয়ে একটি বিভাগের ক্ষুদ্র একটি খণ্ডকে বা ফোকরকে অভীষ্ট লক্ষ্য হিসেবে নির্বাচন করে। ক্ষুদ্র এবং স্বল্প পুঁজির ফার্মের জন্য এই কৌশলটি একটি জুৎসই কৌশল। কিন্তু বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের ছোট একটি বিভাগ অনেক সময় বাজার কোটারি কৌশল অনুসরণ করে। মোট বাজারের ক্ষুদ্র অংশ দখল করে এই নীতির চৌকস প্রয়োগের মাধ্যমে ফার্মের উচ্চ মুনাফা অর্জন সম্ভব। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে মধ্যম আয়তনের প্রায় সবকটি সফল কোম্পানি এই নীতি অনুসরণ করছে। উচ্চ মুনাফা অর্জনের অন্যতম কারণ মাঝেমধ্যে এই সেগমেন্টে পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান বা ফার্মের চেয়ে যে নিয়মিতভাবে কোন খণ্ডাংশে বা বাজার উপবিভাগে পণ্য সরবরাহ করে তার ওই খণ্ডাংশের ক্রেতাদের সম্পর্কে জ্ঞান বেশি থাকে এবং তাদের পরিবর্তিত চাহিদা ভালোভাবে অনুধাবন করতে এবং মিটাতে পারে। যার ফলে বিক্রেতা পণ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য সংযুক্তির মাধ্যমে প্রিমিয়াম মূল্য পেতে পারে। যেখানে গণবাজারী উচ্চ বিক্রয় পরিমাণ অর্জন করে সেক্ষেত্রে কোটারি বাজারি উচ্চ হারে মুনাফায় সন্তুষ্ট থাকে। কোটারি বাজারি এক বা একাধিক নিরাপদ ও লাভজনক কোটর খুঁজে নেয়। একটি আদর্শ বাজার কোটরের অবশ্যই মুনাফা অর্জনযোগ্য আয়তনের এবং প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনায় সমৃদ্ধ হতে হবে। কোটরের আয়তন ফার্মের পক্ষে কার্যকরভাবে সেবা প্রদানের উপযোগী হতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কোটরের প্রতি প্রতিযোগীরা সহজে আকৃষ্ট হবে না।

কিন্তু বাংলাদেশ অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যখনই একজন একটু লাভজনকভাবে ব্যবসায়টি চালাতে শুরু করে তখনই হুড়মুড় করে আরো কয়েকজন একই জায়গায় একই ব্যবসা আরম্ভ করে। বিশেষ ধরনের চাহিদাসম্পন্ন অল্পসংখ্যক ক্রেতা কয়েকজন বিক্রেতার মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে প্রত্যেকেরই মুনাফাযোগ্যতা কমে যায় এবং অলাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। নতুন করে যাতে কেউ এই ব্যবসায় না আসে এমন আইনও করা যাবে না। উন্মুক্ত অর্থনীতিতে যে-কোনো সময় যে-কোনো ব্যবসায় মানুষ চলে আসতে পারে। তবে কোটারি ব্যবসায় শুরু করার সময় বিবেচনা করতে হবে উচ্চ প্রবেশ প্রতিবন্ধকতার বিষয়টি। কারণ যেই ব্যবসায় সহজে কেউ আসতে পারে না সেই ব্যবসাটা শুরু করাই ভালো হবে। আবার একইভাবে অবস্থা বেগতিক দেখলে যাতে সহজেই এই ব্যবসা ছেড়ে নতুন আরেকটি ব্যবসা শুরু করা যায়, সেই ধরনের সুযোগ থাকলে সহজে এই ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। পুরো ব্যাপারটাই অনেকটা ইঁদুরের গর্ত খোঁড়ার মতো। ইঁদুর গর্তে অনেকগুলো কোটর রাখে এবং সেগুলো বিভিন্ন উচ্চতার হয়, যাতে কোনো একটিতে পানি ঢুকে গেল অন্যটিতে সংরক্ষিত খাবার দিয়ে সে টিকে থাকতে পারে।

তবে যখন কোটরের আয়তন বৃদ্ধি পাবে এবং ব্যবসায়ের জন্য আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে তখন কোটারির বাজারের দক্ষতা এবং সুনাম যাতে প্রতিযোগীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে, সে ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। কোটরবাসী ক্রেতাদের মনে এমন একটি অবস্থান নিতে হবে যেখানে আর কারো স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না, তাহলেই কেবল নতুন প্রতিযোগীদের ঠেকানো যাবে। কোটারিপনার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে বিশেষীকরণ। ফার্মগেমে অবশ্যই বাজার, ক্রেতা, পণ্য অথবা বাজারজাতকরণ মিশ্রণের ব্যাপারে বিশিষ্টতা অর্জন করতে হবে।

মার্কেট নিচারের ভ্যালু প্রতিজ্ঞাটি এমন হবে যাতে নির্দিষ্ট ক্রেতা দেখে বা শুনেই বলতে পারে, এইটাই তো খুঁজছিলাম! আমাদের ঢাকা শহরেই অনেক লোক আছে যাদের কোনো সাইজেই মাপা যাবে না, অনেকটা বেসাইজ। এদের উচ্চতা, ওজন, শারীরিক গড়ন কোনোটাই স্বাভাবিক মাত্রায় না। এইসব লোকের জুতা, গেঞ্জি, ইনারওয়্যার ইত্যাদি কিনতে অনেক বেগ পেতে হয়। দোকানগুলোতে সাধারণত ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত সাইজের জুতা, ১৭ ইঞ্চি পর্যন্ত গলার শার্ট, ৪৮ নম্বর পর্যন্ত গেঞ্জি অথবা ডাবল এক্সেল টি-শার্ট রাখা হয়। এর বাইরে কোনো জুতা, শার্ট, গেঞ্জি, টি-শার্ট খুব কম সংখ্যক দোকানে খুঁজে পাওয়া যায়।  এসব অতিকায় সাইজের ক্রেতাকে তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য খুঁজে পেতে মার্কেটের পর মার্কেট ঘুরতে হয়। সে ক্ষেত্রে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় যদি একটি দোকান দেওয়া যায়, যে দোকানের নামই হবে ‘বিগ বস’। সেখানে কেবল অতিকায় সাইজের লোকদের উপযোগী পণ্য থাকবে। গেঞ্জির সাইজ শুরুই হবে ৪৮ থেকে, জুতা শুরু হবে ১০ নম্বর থেকে ইত্যাদি। আমি নিশ্চিত, যারা তাদের প্রয়োজনীয় বৃহৎ সাইজের এই পণ্যগুলো কেনার জন্য ঢাকা শহরের মার্কেটে মার্কেটে তল্লাশি করে বেড়ান, তারা তখন সেটা করবে না। সরাসরি ‘বিগ বস’-এ চলে যাবে।

আমাদের দেশেও বিভিন্ন জায়গায় জুতা তৈরির দোকান আছে। সেই দোকানগুলোতে জুতা থাকে না, চামড়া ঝুলিয়ে রাখা হয়। স্থানীয় কিছু ক্রেতা মূল্য সাশ্রয়ী এবং টেকসই বিবেচনায় এসব দোকানে জুতা তৈরি করলে বেশিরভাগ ক্রেতাই হচ্ছে পা নিয়ে সংকটে থাকা ক্রেতা। কারণ তাদের পায়ের সাইজ ৮ বা ৯ কোনোটাই না। হয়তো পৌনে ৮ অথবা সোয়া ৯; অথবা লম্বা ঠিক আছে, পায়ের পাতা অনেক চ্যাপ্টা। কারো কারো অন্তত একটি পা কিছুটা বাঁকানো। কোনো দোকানের জুতা তাদের পায়ে সুট করে না এবং নতুন জুতা কিনলে বড় ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়। এসব ক্রেতা সরাসরি জুতা তৈরির দোকানে চলে যায়, সেখানে গেলে তাদের পায়ের মাপ নেওয়া হয় এবং তাদের পছন্দমতো ডিজাইনের জুতা চামড়া দিয়ে বানিয়ে দেওয়া হয়। এদেরকে বলা হয় ‘জব সপ স্পেশালিস্ট’।

কোটারি বাজারির সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কোটরটি ভরাট হয়ে যাওয়া বা প্রতিযোগীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া। কেবল একটি নির্দিষ্ট বাজার এবং একটি মাত্র পণ্য নিয়ে একক-বিভাগে কেন্দ্রীকরণ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, যেমন—মেটারনিটি হাসপাতাল। শিশুর জন্মহার কমে গেলে অথবা আশেপাশে আরো কয়েকটি মেটারনিটি হাসপাতাল হয়ে গেলে এই ব্যবসা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। যার কারণে অনেক ফার্ম কয়েকটি কোটর নিয়ে কাজ করে। দুই বা ততোধিক কোটর উন্নয়নের মাধ্যমে ফার্মটি তার টিকে থাকা নিরাপদ করতে পারে। অনেক বড় কোম্পানি পুরো বাজারকে লক্ষ্য নির্দিষ্ট না করে বহুসংখ্যক কোটরকে অভীষ্ট বাজার হিসেবে চিহ্নিত করে। যেমন-একটি ল ফার্ম সাইবার ক্রাইম, চেক জালিয়াতি এবং সরকারি হুকুমদখল-এই তিনটি বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞ সেবাদানকারী  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এটাকে নির্বাচিত বিশেষীকরণ বলা হয়। বাজারের চাহিদা এবং নিজের সক্ষমতা বিবেচনা করে একাধিক মার্কেটে একাধিক সেবা প্রদান করা হয়। এর বাইরেও আরো দুই ধরনের বিশেষীকরণ হতে পারে একটি হচ্ছে পণ্য বিশেষীকরণ, আরেকটি হচ্ছে বাজার বিশেষীকরণ। পণ্য বিশেষীকরণের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা একটি মাত্র পণ্য নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এই পণ্যটি বাজারের সকল খণ্ডের জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করে, যেমন—চক্ষু হাসপাতাল। এখানে কেবল চোখের চিকিৎসা করা হয়, কিন্তু সব ধরনের চোখের রোগীদের এখানে সেবা প্রদান করা হয়। এর বিপরীতে বাজার বিশেষীকরণ হচ্ছে—শিশু হাসপাতাল। এখানে কেবল বাজারের একটি অংশ অর্থাৎ শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়, তবে শিশুদের যত ধরনের স্বাস্থ্যসেবা লাগে সবকটা সেবা প্রদান করা হয়।

তবে কোনো ফার্মের পক্ষেই শুরুতে সকলের জন্য সকল পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করা উচিত নয়। পুরো বাজারকে দখলে নেওয়ার জন্য কেবল বৃহদায়তনের অভিজ্ঞ কোম্পানিই চেষ্টা করতে পারে, যেমন-আইবিএম, ক্যাসিও। আইবিএম সব শ্রেণির এবং সব প্রয়োজনের কম্পিউটার তৈরি করে। একইভাবে ক্যাসিও সব ক্রেতার জন্য, সব ধরনের প্রয়োজনের, এমনকি সব দামের ঘড়ি তৈরি করছে, এটাকে বলা হয় পূর্ণবাজার বিস্তৃতি।

 

লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads