• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

করোনা-পরবর্তী শিক্ষা, শিখন ঘাটতি ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা   

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ৩০ অক্টোবর ২০২১

২০২০ সাল থেকে একটি অভিশপ্ত বছর নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। সেই বছরের মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকেই দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের প্রভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখে। করোনাভাইরাসের প্রভাব বিবেচনায় কিছু দেশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করে। আবার দীর্ঘ সময় ধরেও বন্ধ থাকে অনেক দেশেই। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, এশিয়ার কিছু দেশে।  দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা করোনাভাইরাসের প্রভাবে পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলো শিক্ষাব্যবস্থা। তবে যেসব দেশে যত সুদীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে সেই দেশের ক্ষতির পরিমাণও তত বেশি। আর্থিক ক্ষতি পরিসংখ্যান দিয়ে তুলে ধরা যায়। কিন্তু শিক্ষা খাতের ক্ষতি একটি দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি যা পরিসংখ্যানে তুলে ধরা অসম্ভব। জাতিংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ-এর সম্প্রতি দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, কোভিড-১৯ মহামারিতে পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে। ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর এশিয়ার শিক্ষা খাতের ওপর কোভিড-১৯- এর প্রভাব ও মোকাবেলা কার্যক্রম বিষয়ক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ’ (সিটএন) শীর্ষক প্রতিবেদনে এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করা হয়। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এশিয়ার প্রায় ৪০ কোটি শিশুর পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া যদি আগামী ৯ বছরে জাতিসংঘের ২০৩০ সালের এজেন্ডার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার শিক্ষাবিষয়ক লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তাহলে এ ধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষা বাজেট গড়ে ১০ শতাংশ বাড়াতে হবে। মূলত করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধরনের কারণে একটি দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। কারণ জীবনের নিরাপত্তাই সবার আগে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে ছিল। এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতায় যে সমস্যাগুলো সামনে উঠে এসেছে এবং যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হচ্ছে সেগুলো হলো শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি, শিখন ঘাটতির ক্ষেত্রে গ্রামে থাকা শিক্ষার্থী যারা দূরশিক্ষণে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেনি এবং যারা শহরে বাস করছে তাদের ব্যবধান, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া (ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের বাল্যবিয়ের শিকার হওয়া একটি বড় কারণ এবং দারিদ্র্য এবং আনুষঙ্গিক কারণে ছেলে শিক্ষার্থীদের শ্রমমূলক কাজে অংশগ্রহণ), তাদের পাঠাভ্যাসে ফেরানো এবং কোনোভাবেই মনের ওপর চাপ তৈরি হতে না দেওয়া।

এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্ন সময়ে তাদের ভেতর একঘেয়েমিত্ব বিরাজ করেছে। ফলে করোনা পরবর্তীসময়ে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হবে শিক্ষার্থীদের বইয়ে মনোযোগ ফেরানো। তাদের একটু সময় দিতেই হবে। আর যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা সেটার সমাধান করার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার টেকসই ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। প্রথম থেকেই দূরশিক্ষণ এবং পরে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে অনলাইনে ক্লাসে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত সম্ভব হয়নি। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হবে তবে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, পরিবর্তে স্কুলেই তাদের মূল্যায়ন করা হবে। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, এই পরিস্থিতিতে আমরা যতই চেষ্টা করি শিশুদের লেখাপড়ায় দ্রুত ফিরিয়ে আনতে তা কার্যত দীর্ঘদিনের এই অচলাবস্থায় সম্ভব হওয়া বেশ কঠিন। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনায় কিছু শিক্ষার্থী লেখাপড়ায় রয়েছে তবে যদি বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কথা বলা যায় বিশেষভাবে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শ্রেণির যারা লেখাপড়া করা স্কুল নির্ভর ছিল যে প্রয়োজনীয়তায় তারা বাড়িতেও মনোযোগী হতো বা পরীক্ষায় ভালো করার জন্য বইয়ের সাথে ছিল তারা এই ক্ষতি দ্রুত কাটিয়ে উঠলে অধিকাংশই এর বাইরে। অর্থাৎ মহামারী চলাকালেও কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী লেখাপড়ার মধ্যেই ছিল। তবে এটা খুব কমসংখ্যক। এরপর কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী ছিল যারা অনিয়মিতভাবে হলেও লেখাপড়া করতো। আর একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্রমেই লেখাপড়া থেকে অনেকটাই দূরে থাকে। কিছু উদ্যোগ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করেছে তবে তা অনিয়মিতভাবে। তাছাড়া অনলাইনের সীমাবদ্ধতার দরুণ সবার কাছে পৌছানো সম্ভবও হয়নি। এটি করোনার কারণে সৃষ্ট একটি বৈশ্বিক সংকট। ইতোমধ্যে এই সংকটকাল অতিক্রম করে সামান্য অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। গতবছর শিক্ষার্থীরা একই রোল নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। সেখানেও রয়েছে সমস্যা। আগের ক্লাসে যারা গুরুত্বপর্ণ অধ্যায়গুলো ভালোভাবে বুঝতে পারেনি, তারা বর্তমান ক্লাসের সেই অধ্যায় বুঝতে অনেক সময় নিবে। এ বছর মূল্যায়ন হবে। এতে তাদের দক্ষতা যাচাই করা সম্ভব হবে। যারা লেখাপড়ায় ফিরে এসেছে প্রথমে তাদের মনোযোগ ফিরাতে হবে।

ইউনেস্কো ব্যাংককের পরিচালক শিগেরু আয়োগি বলেন, স্কুলে ফিরে আসা শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বড় ধরনের প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, এশিয়ার ১২ কোটি ৮০ লাখ শিশু মহামারি শুরুর আগে থেকেই স্কুলের বাইরে ছিল, যা বিশ্বব্যাপী স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদের সংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এটি শিক্ষাজনিত একটি সংকট, যা নিরসন করা প্রয়োজন। তবে এর চেয়ে বড় বাস্তব সত্য হলো করোনা ভাইরাসের মতো মহামারীতে শিশুদের নিরাপদ রাখার চিন্তা করা। শিক্ষার দীর্ঘদিনের বন্ধের ফলে সৃষ্ট এই বিশাল ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। শিখন ঘাটতি রাতারাতি পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিয়মিতভাবে বইয়ে ধরে রাখতে সক্ষম হলে ক্রমেই শিখন ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হবে। তবে যারা করোনার কারণে ঝরে গেছে তাদের কতজনকে ফেরানো যাবে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। গত বছর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা যায়নি করোনার কারণে। অটোপাস দেওয়া হয়েছে সবাইকে। স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোতেও তাই হয়েছে। এবছর অ্যাসাইনমেন্ট ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার সীমিতভাবে পরীক্ষাও নেওয়া হবে। ফলে একটি যথাযথ মূল্যায়ন হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের এই অবস্থা কেবল আমাদেরই নয়, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোরও একই অবস্থা। সময়টা অনেক দীর্ঘ এবং এত দীর্ঘ সময় বাড়িতে অবস্থান করার ফলে শিশুর মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক। এ সময়ে শিশু ঝুঁকেছে মোবাইলের স্ক্রীনে। কারণ বাইরে অন্যদের সাথে খেলাধুলা করাও অনিরাপদ। ফলে এতে অভিভাবকেরও সায় ছিল। অনেকেই চেয়েছেন তার সন্তান যেন ঘরের ভেতর থাকে। বাইরে বের হলেই ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এখন শিশুকে সেই অভ্যাস থেকে বের করে আনা অনেকটা্ কষ্টসাধ্য। তাছাড়া এভাবে অনিয়মিত লেখাপড়ার কারণে শিক্ষার্থীর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পরছে। করোনা মহামারী বিশ্বের গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্রাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) কোভিড-১৯ লিভলিহুড অ্যান্ড রিকভারি প্যানেল সার্ভের অংশ হিসেবে চালানো এক গবেষণা তথ্যে দেখা যায়, গ্রাম ও শহরের বস্তি এলাকায়র কমপক্ষে ২২ শতাংশ প্রাথমিক ও ৩০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী স্কুল বন্ধ থাকায় লার্নি লস বা শিখন ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে। গবেষণায় বলা হয়, দূরশিক্ষণের মূল উপায় হলো টেলিভিশনে রেকর্ড করা ক্লাস এবং অনলাইন ও সরাসরি ক্লাস। তবে এসব ক্লাসে থাকার সুযোগ খুব কম শিক্ষার্থীরই হয়েছে। প্রাথমিকে পড়ুয়া ৫৬ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে পড়ুয়া ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মার্চে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লেও কিংবা কোচিং করলেও আগষ্টে সেই হার কমে গাড়ায় যথাক্রমে ৪৮ শতাংশ ও ৪৩ শতাংশ। দেখা গেছে, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের যোগাযোগ তেমন না থাকলেও অ্যাসাইনমেট জমা দেওয়ার সময় যোগাযোগ হতো। অর্থাৎ অ্যাসাইনমেন্ট ছিল বন্ধ থাকার সময়ে লেখাপড়া কার্যক্রম সচল রাখতে একটি অধিক কার্যকর পদ্ধতি। অর্থনীতির ক্ষতি সামাল দেওয়া আর শিক্ষার ক্ষতির ধাক্কা সামাল দেওয়া এক নয়। এখন সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো আগামীতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় বিশেষ করে পাবলিক পরীক্ষা এবং স্কুলের মূল্যায়ন পরীক্ষাগুলো।

 

লেখক : সাংবাদিক

sopnil.roy@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads