• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সেক্যুলার রাজনীতির দ্বৈত ভূমিকা

  • প্রকাশিত ০৯ নভেম্বর ২০২১

জি. কে. সাদিক

 

বৈশ্বিক রাজনীতিতে উদার গণতন্ত্র ও সেক্যুলারজিমের নিম্নমুখী যাত্রায় উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান দেশে আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। কেবল যদি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, কেবল ধর্ম পরিচয় ও জাতিগত আত্মপরিচয়ের জন্য লাখ লাখ মানুষের জীবন দুবির্ষহ হয়ে উঠেছে। যেমন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এ ছাড়া রয়েছে শান, ক্যারেন ও কোচেন জনগোষ্ঠী। তবে দেশটিতে সবচেয়ে মানবিক বিপর্যয়কর ঘটনা হচ্ছে সরাসরি রাষ্ট্রীয় মদদে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো গণহত্যা। একইভাবে ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো বিভিন্ন সময়ের হত্যাযজ্ঞ, দাঙ্গা ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া ঘটনা। পাকিস্তানে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ধর্মাবমাননার দোহাই তুলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর বৃহৎ ধর্মানুসারীদের সহিংস আক্রমণ এবং সেগুলোর বিচার না হওয়া। জাতিগত এসব বিষবাষ্পের ফলে গোটা উপমহাদেশের রাজনৈতিক চিত্রটাই পাল্টে যাচ্ছে। এক দেশের সহিংসতা অন্য দেশেও সংক্রমিত হচ্ছে। বেঘোরে প্রাণ দিচ্ছে নিরীহ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে মানুষের আস্থার জায়গা হয়ে ওঠার কথা ছিল উদার গণতান্ত্রিক সেকুলার রাজনীতি বরং সেটা না হয়ে উল্টো উগ্রজাতীয়বাদী ও ধর্মীয় রাজনীতির পালেই হাওয়া আরো জোরদার হচ্ছে। তাই প্রশ্ন উঠছে সেক্যুলারজিম কী তার আবেদন হারিয়ে ফেলছে?

বিশ্বব্যাপী উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি ক্রান্তিলগ্ন পার করছে। একই দশা উপমহাদেশের রাজনীতিতেও। পশ্চিমের তথাকথিত আধুনিকতার বৈশ্বিক প্রচারে যেখানে উদার গণতন্ত্র ও সেকুলার মতবাদ অধিকতর মানবতাবাদী হিসেবে পরিচিতি পেল সেখানে সাধারণ মানুষ কোনো পরিস্থিতিতে এই দুটো মতবাদের ঠিক বিপরীত মতবাদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে! উদার গণতন্ত্র ও সেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শনের ‘কাউন্টার ফিলসফি’ হচ্ছে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, গোটা বিশ্বেই উদার গণতন্ত্র ও সেকুলারজিমকে কাউন্টার করেই উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বেশ শক্তিমত্তা নিয়ে উদ্ভাসিত হচ্ছে। এটা যেমন আগামীদিনে বৈশ্বিক রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক তেমনি মানবতার জন্যও বিপজ্জনক।

অনুরূপ তথা একই ধরনের দুটি ভিন্ন ঘটনা নিয়ে দ্বৈত ভূমিকা যে কোন মতবাদ বা দর্শনের জন্য ক্ষতিকর। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পশ্চিম থেকে প্রচারিত উদার গণতন্ত্র ও সেকুলারজিম সেই ক্ষতির শিকার হয়েছে। কারণ তারা অনুরূপ দুটি ভিন্ন ঘটনায় দ্বৈত চরিত্রের ভূমিকা রাখছে, যা সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। অনেক ক্ষেত্রে সেই সন্দেহ দালিলিক বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষ এই দুই মতবাদের প্রতি ক্রমেই আস্থাহীন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে তারা কবলিত হচ্ছে উগ্রজাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দর্শনের থাবায়। যদি উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সেকুলারজিম তার এই দ্বৈত চরিত্রের ‘প্যারাডক্স’ থেকে বের হতে না পারে তাহলে সাধারণ মানুষ হয়তো উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকেই আশ্রয়স্থল হিসেবে চূড়ান্ত রায় দেবে। এর ফল হবে ভয়াবহ।

কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনা করলে সুবিধা হবে। উদাহরণের জন্য বেশি দূর অতীতে যেতে হবে না। গত শতাব্দীতে ল্যাতিন আমেরিকার দেশ চিলি, এলসালভাদর, গুয়েতেমালাসহ গোটা মহাদেশটিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের ব্যবসায়িক পুঁজির স্বার্থে দেশে দেশে জনগণের রায়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উচ্ছেদ করে তাদের মদতপুষ্ট দল ও ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে যে হত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারপর সেই দেশগুলোতে আর পশ্চিমের উদার গণতন্ত্র ও সেক্যুলারজিমের বয়ান খাটে না। একইভাবে ইরাকে-সিরিয়ায়-ফিলিস্তিনে ধ্বংসযজ্ঞ ও তাদেরই মদতে গণহত্যার পর মধ্যেপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পশ্চিমের উদার গণতন্ত্রের বুলি ও সেক্যুলার রাজনীতির দীক্ষা আর কেউ গ্রহণ করতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ ইরাকে কল্পিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস ও দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার ও সন্ত্রাস দমনের নামে যে ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা চালানো হয়েছে তাতে খোদ গণতন্ত্র ও সেক্যুলারজিম নিয়ে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক মনোভাব আশা করা অমূলক। গণতন্ত্র ও সেকুলার রাজনীতির ধারক-বাহক ও প্রচারকদের যে বিধ্বংসী তাণ্ডব বিশ্বের জনগণ দেখেছে তাতে তাদের ওপর বিশ্বাস রাখার কোনো কারণ নেই। একইভাবে সিরিয়াতে স্বৈরাচারী আসাদের উচ্ছেদ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যা হয়েছে তা স্রেফ ‘ম্যাসাকার’। বরং তার চেয়েও বেশি। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদকে মিলিয়ে দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। পশ্চিমারা ফিলিস্তিন ইস্যুতে যে দ্বৈত আচরণ দেখিয়েছে তাতে পশ্চিম যে উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সেক্যুলারজিমের দীক্ষা দেয়, তার ওপর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠীই নয় গোটা বিশ্বের মুসলিমদের মনেই অবিশ্বাস স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে।

একইভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন তথা গণহত্যা চালানোর পরও পশ্চিমা বিশ্ব যে নির্বিকার আচরণ দেখিয়েছে, এতে তাদের মানবাধিকার রক্ষার বৈশ্বিক যে প্রচারণা সেটাকে ‘মানবাধিকার ব্যবসা’ বই অন্যকিছু মনে না করার যৌক্তিক কারণ নেই। আবার কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার দাবিকে সন্ত্রাস বলে চালানো এবং সেটাকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে উপমহাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনে পশ্চিমাদের মানবাধিকার রক্ষার তৎপরতাকে সন্দেহের চোখে দেখার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কারণ চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের নির্যাতন নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তথা আমেরিকা যে পরিমাণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখিয়েছে ঠিক ততটাই নীরবতা পালন করেছে কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার দাবি ও নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকারের বিষয়ে। এমন দ্বৈত চরিত্র স্পষ্ট হওয়ার পরও পশ্চিম কর্তৃক প্রচারিত উদার গণতন্ত্রের শিক্ষা ও সেক্যুলার রাজনীতির প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা মোটামুটি অসম্ভবই বলা চলে। এই অবিশ্বাস কেবল মুসলিম জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকেই বিষয়টি এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ অন্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী যখন দেখছে তাদের পাশেই একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদার গণতন্ত্রের তলপিবাহক ও সেক্যুলার রাজনীতির দেশি-বিদেশি দীক্ষাগুরুরা নির্বিকার তখন তাদের পক্ষে এই মতবাদে আস্থা রাখাও কঠিন। ঠিক উল্টো ঘটনা যদি ঘটে তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও যে এমনটা ঘটবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলে বিশ্বব্যাপী জাতিগত সংঘাত, উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাড়ন্ত প্রভাব সহজে বন্ধ হবার আলামত মিলছে না।

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা অনেক উদাহরণ পাব। একই সঙ্গে আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম মানুষ দেখছে না। যেমন তারা প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, সম্যবাদী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের আচরণ দেখেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী, ডানপন্থি ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের আচরণও তারা দেখেছে। অল্প কিছু হেরফের বাদে মৌলিক পার্থক্য নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি, ঘুষ, লুণ্ঠন, হত্যাযজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জনগণের অধিকার হরণের ক্ষেত্রে সর্বদলীয় ঐক্যের বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতা এবং তাদের সম্পত্তি জবরদখলের ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি কেউই কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। একইভাবে জাতিগত নিধনের বিষয়েও মানুষ যাদের কাছ থেকে প্রতিবাদের ডাক আশা করে, তারা সব সময়ই জনতার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে পিছিয়ে থেকেছে, পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনায় দেশময় যে প্রতিবাদ হয়েছে, ঠিক একই রকম সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনায় ভারতের ও বাংলাদেশের প্রগতিশীল সেক্যুলার ঘরানার রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের নীরবতা সাধারণ মানুষের মনে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্বেগ ঘটিয়েছে। গেলো দুর্গাপূজায় বাংলাদেশে ধর্মাবমাননার অভিযোগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর যে ঘৃণ্য হামলার ঘটনা ঘটেছে তা যে-কোনো বিবেকবান মানুষের মনে সায় দেয়নি। মানুষ তার প্রতিবাদ করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এই ঘটনা নিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহল থেকে প্রতিবাদ হয়েছে। গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটছে ভারতের ত্রিপুরা ও আসামে। সেখানে কেবল মুসলিম বলেই মানুষ হত্যার শিকার হচ্ছে। স্রেফ ধর্ম পরিচয়ই তার জীবনধারণের অধিকারকে কেড়ে নিচ্ছে। তাদের জান-মালের কোনো নিরাপত্তা নেই। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বজরং দলের নেতৃত্বে সরাসরি হামলা হচ্ছে ত্রিপুরায় মুসলিমদের ওপরে। তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে, এই ঘটনায় ভারতেই প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ করছে না। একই ঘটনা বাংলাদেশেও। এখানেও এই ঘটনায় কোনো প্রতিবাদ এখনো পর্যন্ত হয়নি। বিষয়টিকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। এমন আচরণে সাধারণ মানুষের মনে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সেক্যুলার রাজনীতিকদের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ নেই।

রাজনীতির অন্দরমহল বড়ই অদ্ভুত! তবে সাধারণ মানুষ সেই অদ্ভুত মহলের ধার ধারে না। তারা চায় কে তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে? সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা চিন্তা সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব সীমিত সংখ্যাক লোকের আছে। তারা নগদ পাওনায় বিশ্বাসী ও আস্থাশীল। উগ্রজাতীয়তাবাদী ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আখেরে গোটা বিশ্বকেই হুমকির মুখে ফেলবে, সেই হিসাব বুঝার রাজনৈতিক জ্ঞান সাধারণ মানুষে মধ্যে কমই আছে। তারা সেটাই দেখবে যেটাতে তাদের আপাতত লাভবান হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। সেক্যুলার ও উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গ যত তাড়াতাড়ি এই হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন, ততই মঙ্গল হবে। অন্যথায় উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির তোড়ে ভেসে যাওয়ারসমূহ সম্ভাবনা আগামীর দরজায় কড়া নাড়ছে।

 

লেখক : মুক্তগদ্য লেখক

sadikiu099@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads