• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
দোয়েলে ডুবছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ

দোয়েল ল্যাপটপ

ছবি : সংরক্ষিত

শিক্ষা

আইএমইডির প্রতিবেদন

দোয়েলে ডুবছে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ

# নিষ্ক্রিয় ৪৩ শতাংশ ল্যাপটপ, অকেজো ২৮ শতাংশ প্রজেক্টর # ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের কথা জানে না ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী

  • জাহিদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ০২ অক্টোবর ২০১৮

২০১১ সালের অক্টোবরে দেশি ব্র্যান্ড ‘দোয়েল’ ল্যাপটপের সংযোজন ও বাজারজাতকরণ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগেই দোয়েল বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান সরকারের মালিকানাধীন টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে (টেশিস) ২৩ হাজার ৩৩১টি ল্যাপটপ সরবরাহের কার্যাদেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। এসব ল্যাপটপ ব্যবহার হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপন প্রকল্পে। প্রকল্পের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় থাকা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি করে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ চালু করা হয়। শ্রেণিকক্ষে দোয়েল ল্যাপটপের পাশাপাশি ব্যবহার করা হয় একটি করে প্রজেক্টর, মডেম ও স্পিকার। তবে ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষের প্রায় অর্ধেক অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

২০১৫ সালে শেষ হওয়া ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা প্রচলন’ শীর্ষক প্রকল্পের সাফল্য পর্যালোচনায় সম্প্রতি ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ সমীক্ষা আয়োজন করে আইএমইডি। সমীক্ষার ফলে বলা হয়েছে, প্রকল্প শেষ হওয়ার মাত্র তিন বছরের মধ্যে বিতরণ করা ল্যাপটপের ৪৩ শতাংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। নিষ্ক্রিয় আছে প্রকল্পের ২৮ শতাংশ মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর।

সূত্র জানায়, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে বাস্তবায়ন শুরু করতে প্রকল্পটি একই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন দেওয়া হয়। পরের বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। পরে ব্যয় ৩০৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকায় নামিয়ে এনে প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। সর্বমোট চার দফায় সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। ২ বছরের প্রকল্পে অতিরিক্ত সময় লাগে আড়াই বছর। তবে ব্যয় হয় ২৯৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ২৪ শতাংশ ল্যাপটপ পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট অবস্থায় আছে ১৪ শতাংশ ল্যাপটপ। আর নিম্নমানের কারণে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করা যাচ্ছে না ১৫ শতাংশ ল্যাপটপ। এ ছাড়া প্রকল্পের ১৪ শতাংশ প্রজেক্টর নষ্ট হয়ে গেছে; অনুপযুক্ত প্রজেক্টর আছে ১৫ শতাংশ। আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পড়ে আছে ৬ শতাংশ প্রজেক্টর। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, বিতরণ করা মডেমের ৯ শতাংশ বাতিল হয়ে গেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পড়ে আছে ৮ শতাংশ আর ৯ শতাংশ মডেম কখনো কোনো কাজে আসেনি।

প্রকল্পের নিম্নমানের ল্যাপটপ, প্রজেক্টর ও অন্যান্য উপকরণ প্রায় সবসময়ই মেরামতের কারণে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, প্রকল্পের ৭৮ শতাংশ উপকরণ ১০ বার পর্যন্তও মেরামত করা হয়েছে। এর চেয়ে বেশিবার মেরামত করতে হয়েছে ১৩ শতাংশের। আর কখনো মেরামত লাগেনি মাত্র ৯ শতাংশের।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ইতোমধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠানের মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রকল্পের আওতায় ছিল এমন প্রতিষ্ঠানের ২২ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষই নেই। ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সপ্তাহে একবার এমন কক্ষে ক্লাস করার সুযোগ পায়। দুইবার সুযোগ পায় ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। আর সপ্তাহে তিনবার এমন সুযোগ পায় ২৭ শতাংশ এবং তার চেয়ে বেশিবার সুযোগ পায় ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী।

সরবরাহ করা ল্যাপটপ ও প্রজেক্টরের মান ভালো নয় বলে সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী মতামত দিয়েছে। এসব যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রযুক্তিভিত্তিক ক্লাসের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। ডিজিটাল ক্লাসের কনটেন্ট ঘাটতিকে বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। প্রকল্পের সুফল না পাওয়ার জন্য ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী দায়ী করছে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাবকে। অবশ্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ না থাকায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাস বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মত দিয়েছে ৮৪ থেকে ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী।

সমীক্ষার আওতায় আসা প্রকল্পের পটভূমিতে বলা হয়, প্রযুক্তির জ্ঞান নেই এমন মানুষ বর্তমানে অজ্ঞ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। সহজলভ্য উন্নত প্রযুক্তি ও ডিজিটাল কনটেন্ট ব্যবহার করে দক্ষ ও প্রত্যয়ী শিক্ষার্থীদের প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি করার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। গণিত, অর্থনীতি, বিজ্ঞান এবং ভাষা শিক্ষার মতো কঠিন বিষয় আয়ত্তে আনতে প্রযুক্তিগত শিক্ষা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। এরই অংশ হিসেবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্পটি নেওয়া হয়ছিল।

এ বিষয়ে আইএমইডির সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে নেওয়া প্রকল্পটির সুফল সম্পর্কে জানতে সমীক্ষাটি পরিচালনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইএমইডি সচিব। এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করে সুপারিশ আকারে তা প্রতিবেদনে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

আইএমইডি সচিব বলেন, বড় প্রকল্পের কাজ শেষে অবকাঠামো ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে অর্থ বরাদ্দ রাখা উচিত। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় নেওয়া প্রকল্পে এখনো এ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এর ফলে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই অবকাঠামো ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ প্রকল্পটি এ ধারাবাহিকতার বাইরে নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

টঙ্গীতে অবস্থিত দোয়েল ল্যাপটপ প্ল্যান্ট ও সেবাকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, ইতোমধ্যে দোয়েল ব্র্যান্ডের ১৩টি মডেলের মজুত শেষ হয়ে গেছে। বড় ধরনের কোনো কার্যাদেশ পাওয়া না গেলে এসব মডেলের ল্যাপটপ আর উৎপাদন করা হবে না। বাজারে এখন সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের তিনটি মডেলের ল্যাপটপ আছে। এর মধ্যে কোরআই৫ ও কোরআই৭ প্রসেসরের ল্যাপটপের দাম তুলনামূলক বেশি। কোয়ার্ডকোর প্রসেসরের ফ্রিডম ল্যাপটপের দাম ২৩ হাজার ৬০০ টাকা। এর বাইরে আরো কিছু মডেল বাজারে আসার অপেক্ষায় আছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী জিএম রাকিব হাসান। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি শিক্ষার প্রকল্পে নিম্নমানের ল্যাপটপ সরবরাহের বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads