• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
নিষ্কণ্টক পরীক্ষায় কোচিং সেন্টার বন্ধের পূর্বাভাস

কোচিং সেন্টার

সংগৃহীত ছবি

শিক্ষা

নিষ্কণ্টক পরীক্ষায় কোচিং সেন্টার বন্ধের পূর্বাভাস

# ফার্মগেটে কোচিং অ্যাসোসিয়েশন নামে দোকান খুলল কোচিংবাজরা # শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আজ সংবাদ সম্মেলন # ঢাকায় সব কোচিং সেন্টার বন্ধের দাবি পুলিশের

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর ২০১৮

আসন্ন জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা সামনে রেখে কোচিংওয়ালাদের পোয়াবারো। শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে চটকদার বিজ্ঞাপন ব্যবহার করছে তারা। শিক্ষাবিদ ও পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, এই কোচিং সেন্টারগুলোই প্রশ্নফাঁসের বড় কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত। পরীক্ষার আগে অবশ্যই কোচিং সেন্টারগুলোকে বন্ধ করতে হবে। পুলিশের ভাষায়, এখনই কোচিং সেন্টার বন্ধ না করলে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে দেশের পরীক্ষা ব্যবস্থায়। আগামী ১ নভেম্বর থেকে জেএসসি ও জেডিসি এবং ১৮ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে পিইসি পরীক্ষা। আজ সোমবার বিকাল তিনটায় পরীক্ষা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পুলিশ বলছে, নির্বাচনের আগে শিক্ষাব্যবস্থা বিতর্কিত করতে সক্রিয় একাধিক চক্র। ওই চক্রটি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস করতে চেয়েছিল। কিন্তু কড়া নজরদারি এবং কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকায় তা সম্ভব হয়নি। পরে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দিকে নজর দেয় এবং ‘ঘ’ ইউনিটে মোটামুটি সফলও হয়। এখন আসন্ন জেএসসি ও জেডিসি এবং পিইসি পরীক্ষা সামনে রেখে কোচিং সেন্টারকে ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পুরো প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে চায়। এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে কাজ করছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের ছয়টি দল। পরীক্ষার আগে সব কোচিং সেন্টার বন্ধ চায় পুলিশ। ঢাকা মহানগরীর কোথায় কত কোচিং সেন্টার রয়েছে, তারও তালিকা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পুলিশ। পুলিশের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী কেবল ঢাকা মহানগরীতেই আছে ৪৮৮টি কোচিং সেন্টার। এর মধ্যে রমনা জোনে ৪৬, লালবাগে ৫১, মতিঝিলে ৯৬, ওয়ারীতে ৫২, গুলশানে ২০, তেজগাঁওয়ে ৬৪, মিরপুরে ৮৮ ও উত্তরায় ৩১ কোচিং সেন্টার। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শেখ নাজমুল আলম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসমুক্ত পরীক্ষা চাইলে অবশ্যই কোচিং সেন্টার বন্ধ করতে হবে। এ জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগরীর কোচিং সেন্টারের একটি তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার কবে থেকে বন্ধ হচ্ছে, তা জানতে আগামী সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে খবর নেব। তিনি বলেন, প্রশ্নফাঁসরোধে স্পষ্টভাষায় বলতে হবে এত তারিখ থেকে কোচিং সেন্টার বন্ধ। সাজেশন্সের নামে ফেসবুকে কোনো প্রশ্ন আপলোড করা যাবে না। এ ছাড়া সরকারবিরোধী শিক্ষকদেরও নজরদারিতে রাখতে হবে। কারণ তারাই বলে বেড়াচ্ছে- বোর্ড থেকে উত্তরপত্রে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

পুলিশের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্ব্বয়ক অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বাংলাদেশের খবরকে বলেছেন, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে কি না, এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ধরে নেন পরীক্ষার সময় কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে কড়া নজরদারিও থাকবে।

তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেছেন, পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে কি না, তা শিগগিরই একটি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত হবে। কবে এ বৈঠকটি হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই। ওই বৈঠকেই কোচিংওয়ালাদের বিষয়ে চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা আয়োজনের জন্য যা যা করা দরকার, তার সবই করা হবে বলে জানান তিনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর আজিমপুরে আসন্ন জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষাকে সামনে রেখে ব্যানার-পোস্টারে ছেয়ে গেছে চায়না বিল্ডিংয়ের গলি। কোচিং সেন্টারগুলো এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করছে তাদের কোচিংয়ে ভর্তি হতে। আর ভালো ফলাফলের চাপ ও প্রলোভনে পড়ে বরাবরের মতোই শিটভিত্তিক এসব কোচিং সেন্টারে ঝুঁকে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর কোচিং সেন্টারগুলোয় বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকরাই এসব শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। তাদের দাবি, নিজেদের আর্থিক সচ্ছলতা ও শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে পাঠদান করছেন তারা। সঙ্গে ব্যবসা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়ারী এলাকার একটি কোচিং সেন্টারের একজন শিক্ষক বলেছেন, অন্তত ৫০ হাজার টাকা লাগে এই সিটিতে বসবাস করতে। একজন শিক্ষককে কখনোই প্রতিষ্ঠান থেকে এই টাকা দেওয়া হয় না। বাধ্য হয়ে কোচিং করাই। তবে শাহজাহানপুর এলাকার একজন শিক্ষক কোচিং পড়িয়ে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে মন্তব্য করেছেন।

অথচ ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে স্কুলের শিক্ষকদের তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করানোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা উপেক্ষা করে কোচিং সেন্টারগুলো শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করে চলেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ফার্মগেট কোচিং পাড়া হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা, প্রফেশনাল কোর্স কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল এ এলাকার। সেখানে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে একাডেমিক কোচিং। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষাকে ঘিরে এ এলাকার কোচিং-বাণিজ্য এখন রমরমা।

গত বুধবার ফার্মগেটের পাশে পূর্ব তেজতুরী বাজার এলাকার বিসিএ কোচিং সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, তিনতলা ভবনের প্রায় প্রতিটি কক্ষেই কোচিং ক্লাস চলছে। ভরদুপুরে এ কোচিংয়ে একই সঙ্গে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি করে ব্যাচ পড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি অন্য ক্লাসেরও ব্যাচ পড়ছে। কোচিংয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আল আমিন জানান, তাদের কোচিংয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের প্রায় সবাই ফার্মগেট এলাকার বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ (স্কুল শাখা) ও হলিক্রসের মতো স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আছে। মূলত স্কুলে পড়ালেখার যে ঘাটতি, সেটুকু পূরণের জন্যই শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে থাকে বলেন তিনি।

রাজধানীর পল্লবীতে অর্ণব একাডেমি নাম দিয়ে কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার চরবগা এলাকার ২৮ বছরের রুবেল হোসাইন। তার কোচিং সেন্টারে ছয়জন শিক্ষক রয়েছেন। এখানে তৃতীয় শ্রেণি থেকে কোচিং শুরু হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কোচিং সেন্টারের দুজন শিক্ষক বলেন, স্কুলে কোনো পড়ালেখাই হয় না। বিশেষ করে সৃজনশীল বিষয়গুলো শিক্ষকরা যেমন বোঝেন না, তেমনি পাঠ্য বইয়েও বিস্তারিত কিছু নেই। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে বই পড়ে বুঝবেন, তা হচ্ছে না। বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের কোচিংমুখী হতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোচিং আছে বলেই অভিভাবকরা কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন বলে মনে করেন তারা।

কেবল ফার্মগেট কিংবা পল্লবী এলাকা নয়, অলিগলিতে কোচিং সেন্টার গজিয়ে ওঠার এই চিত্র ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ভালো হিসেবে পরিচিত স্কুল-কলেজ রয়েছে, সেসব স্কুল-কলেজকে ঘিরেও গড়ে উঠেছে প্রচুর কোচিং সেন্টার। এর কোনোটিতে প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি, কোনোটিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, আবার কোনোটিতে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্তও পড়ানো হয় শিক্ষার্থীদের। কিছু কিছু কোচিং আবার মূলত পাবলিক পরীক্ষাকেন্দ্রিক ও মডেল টেস্টনির্ভর। আর স্কুলে ভর্তির জন্য কোচিং তো রয়েছেই।

এই কোচিংওয়ালারা রাজধানীর ফার্মগেটে ‘কোচিং অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনেরও জন্ম দিয়েছে। এই সংগঠন থেকে একটি নোটিশ জারি করে বলা হয়েছে, ‘ফার্মগেটে অবস্থিত সব কোচিং পরিচালক ও মালিকদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, গত ১৬ জুলাই তারিখে কোচিং অ্যাসোসিয়েশনের সভায় ছাত্রছাত্রীদের বেতন-টিউশন ফি পরিশোধের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত টিউশন ফি পরিশোধ করবে। অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা চলতি অক্টোবর পর্যন্ত টিউশন ফি পরিশোধ করবে। অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভর্তির পর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টিউশন ফি পরিশোধ করবে। ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেও প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে যথাসময়ে টিউশন ফি পরিশোধ করতে হবে।

অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রায় সাড়ে ছয় বছর ধরে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত বছর কোচিং, প্রাইভেট ও সব ধরনের নোট-গাইড, অনুশীলন বা সহায়ক বই নিষিদ্ধ করে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ওই খসড়ায় সহায়ক বা অনুশীলন বই প্রকাশেরও সুযোগ রাখা হয়নি। এসব অপরাধে কেউ জড়িত হলে জেল-জরিমানা বা চাকরিচ্যুত (শিক্ষক হলে) করা হবে এমন বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু সেটি এখন ফাইলবন্দি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads