• শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪২৯
প্রাথমিকে শিক্ষার মানোন্নয়নে পরিদর্শন নয়, ‘ভ্রমণ’ই সার

লোগো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়

শিক্ষা

প্রাথমিকে শিক্ষার মানোন্নয়নে পরিদর্শন নয়, ‘ভ্রমণ’ই সার

# নতুন দায়িত্ব ৬২ কর্মকর্তার # ২০১৬ সালের পরিদর্শন প্রতিবেদনের হদিস নাই

  • অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
  • প্রকাশিত ০৬ নভেম্বর ২০১৮

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে গত ১ নভেম্বর ৬২ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়ে নতুন নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ৫ বছরে ৫ দফা এ নির্দেশনা জারি করে মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ শিক্ষা অফিস পরিদর্শনের জন্য মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে। দেশজুড়ে এ কর্মসূচি ইতিবাচক হয়েছে কিনা তার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি।

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, এ কর্মসূচি পরিদর্শনে দফায় দফায় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হলেও তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখেন না। দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট জেলায় গিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেখেই ঢাকায় চলে আসেন। কার্যকর পরিদর্শন প্রতিবেদন না দিয়েই পরিদর্শনে যাওয়া কর্মকর্তারা ‘টিএ-ডিএ’ বিল বাবদ টাকা তুলে নেন। ফলে পরিদর্শনের নামে কর্মকর্তাদের প্রমোদ ভ্রমণ হয়। মন্ত্রণালয় যে উদ্দেশ্যে কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয় তা সফল হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ঠিকঠাক পরিদর্শন প্রতিবেদন দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ওই কর্মকর্তার মতে, গত বছর একটি জেলায় পরিদর্শন শেষে মনোযোগ দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। আজ পর্যন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। এ কারণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছি। তিনি বলেন, এবারো যাব। এসে দায়সারা একটি প্রতিবেদন জমা দিয়ে দেব। প্রতিবেদন অনুযায়ী কাজ হলে হোক না হলে নাই। পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফিরলে ‘ভ্রমণ বিল’তো পাই।

জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে যুক্ত হওয়ার দরকার। কিন্তু কোনো বিদ্যালয় যদি একবার পরিদর্শনের পর অন্য কেউ ওই একই বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান সেক্ষেত্রে আগের পরিদর্শন প্রতিবেদনটি আমলে নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাজের ধারাবাহিকতা থাকে বলে তিনি জানান। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বিশিষ্টজনদের নিয়ে একটি পরামর্শক কমিটিও করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

কর্মকর্তাদের ওপর এমনিতেই পরিদর্শনের দায়িত্ব রয়েছে তবু আদেশ জারি করে পরিদর্শনের কথা বলার কারণ জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, কোন শিক্ষা অফিস ভালো চলছে না অথবা কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মানসম্মত পাঠদান হয় না- কথাটি মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা পরিদর্শন প্রতিবেদনে আজ পর্যন্ত বলেননি। অথচ আমরা এসব বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বিস্তর অভিযোগ পাচ্ছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে সত্যতা যাচাই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিদর্শনের দায়িত্ব আগেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে কী হয়েছিল তা জানার দরকার নেই। এখন কী হবে সেটাই দেখেন। গত কয়েক দিনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সচিবের ডাকফাইলে তল্লাশিতে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি জেলা থেকে মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা হয়েছে। কিন্তু অভিযোগের পর এ নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই। এটি পড়ে থাকে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি হওয়া আদেশে দেখা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব নিজেও পরিদর্শনে যাবেন। এ ছাড়া ১১ অতিরিক্ত সচিবকে দেশের ৮ বিভাগের প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালের আগস্টে বিদ্যালয় পরিদর্শনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব আকরাম আল হোসেন খুলনা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব হিসেবে বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে কী কী ত্রুটি পেয়েছিলেন তা জানা যায়নি। এ অবস্থায় নতুন আদেশে তিনি সচিব হিসেবে মাগুরা ও যশোর জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করবেন। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মহাপরিচালক তপন কুমার ঘোষ সাতক্ষীরা জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ২০১৬ সালের আদেশে রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করবেন। কিন্তু সেই সময় তিনি পরিদর্শনে কী পেয়েছিলেন তা এখনো নথির মধ্যেই রয়ে গেছে। নতুন আদেশে তিনি পিরোজপুর জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করবেন। অতিরিক্ত সচিব বেগম হোসনে আরা আগের আদেশে দেখছিলেন ঢাকা এবং রংপুর বিভাগ। কিন্তু নতুন আদেশে তিনি মানিকগঞ্জ জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।

আদেশে আরো বলা হয়, যুগ্ম-সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তারা জেলাওয়ারি প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং বিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন। সবমিলিয়ে ৬২ কর্মকর্তা পরিদর্শন কাজে শামিল হবেন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড’ কর্মসূচি পালন, শিশুদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ‘রিডিং, রাইটিং, স্পিকিং এবং লিসেনিং’-এ গুরুত্ব দেওয়া, ‘ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড’ কর্মসূচির আওতায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করা, মিড ডে মিল বাস্তবায়ন করা, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া, বিদ্যালয়ের আঙিনা এবং ওয়াশব্লক পরিষ্কারে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করাসহ নানা বিষয় সশরীরে হাজির হয়ে খতিয়ে দেখতে এসব কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১ নভেম্বর অফিস আদেশ জারি হওয়ার পর দেখা গেছে, বিদ্যালয় দর্শনে যে ৬২ কর্মকর্তা দায়িত্ব পেয়েছেন তারা সবাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরে কর্মরত। তবে অনেকেই বলছেন, পরিদর্শনের নামে কর্মকর্তারা শুধু ‘ভ্রমণ’ করেন। পরিদর্শন শেষে ঢাকায় ফিরে ‘ভ্রমণ বিল’ তুলে নেন। কাজের কাজ কিছুই হয় না।

আদেশে বলা হয়েছে, দায়িত্ব পাওয়া কর্মকর্তারা পরিদর্শনের সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা লেসন প্ল্যান অনুযায়ী ক্লাস নিচ্ছেন কি না, ল্যাপটপ ব্যবহার করছেন কি না তা খতিয়ে দেখবেন। এ ছাড়া  মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এবং বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করবেন এবং তিন মাস অন্তর পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেবেন। তারপর মন্ত্রণালয় এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে। অনির্দিষ্টকালজুড়ে চলবে এই ‘পরিদর্শন যজ্ঞ’।

 

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads