• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯
ইউজিসির সিদ্ধান্ত ঠেকাতে একাট্টা প্রভাবশালীরা

ফাইল ছবি

শিক্ষা

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা

ইউজিসির সিদ্ধান্ত ঠেকাতে একাট্টা প্রভাবশালীরা

  • সাইদ আরমান
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তিপরীক্ষা এখন জাতীয় দাবি। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরাও দীর্ঘদিন যাবৎ এ দাবি করে আসছেন। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকেই এটি কার্যকর করতে চায় সংস্থাটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন চেষ্টা করছে এটা ঠেকাতে। ইউজিসির সিদ্ধান্ত আটকাতে একাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছে প্রভাবশালীদের একটি অংশ।

জানা গেছে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাস্তবায়নে সর্বশেষ গতকালও বৈঠক করেছে ইউজিসি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি অংশের একাট্টা হওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকার অসহায় ও নতি স্বীকার করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের মতে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সে জন্য জাতীয় প্রত্যাশা থেমে থাকতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চান লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় তাদের। এ জন্য আলাদাভাবে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। ভর্তি পরীক্ষাও আলাদাভাবে আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়।

ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যের এক প্রতিনিধিদল ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী শহীদুল্লাহর সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতে এ কথা বলেন। এ সময় ক্যাবের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধান ও গবেষণা কমিশনের সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. দিল আফরোজা বেগম, প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর ও কমিশনের জনসংযোগ ও তথ্য অধিকার বিভাগের পরিচালক ড. এ কে এম শামসুল আরেফিন উপস্থিত ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে এখনো দ্বিধায় রয়েছে। ইউজিসির পক্ষ থেকে ঘোষণা এলেও এসব বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা নিতে চায়, যদিও গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষায় অংশ নিতে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের চাপও রয়েছে বলে জানিয়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক নেতারা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো আলোচনা করছে বিভিন্ন স্তরে। একাডেমিক কাউন্সিলের সভায়ও আলোচনা নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া এ বিষয়ে ৭৩-এর অ্যাক্ট অনুসারে চলা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একমত হওয়ার ব্যাপার আছে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সবার সিদ্ধান্তের ওপরই বিষয়টি নির্ভর করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রক্রিয়া অনুসৃত হচ্ছে। এখন যদি নতুন কোনো পদ্ধতি আনতে হয়, সেক্ষেত্রে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিন্ডিকেট, সিনেট, ডিনস কমিটিসহ বিভিন্ন ধরনের ফোরাম রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ধাপে আলোচনার মাধ্যমে সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ইউজিসির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয় একমত হলে এ প্রক্রিয়ায় আসতে মত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে দ্বিধায় রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও (বুয়েট)। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আজ ইউজিসি সদস্যদের সঙ্গে সভা করবে বুয়েটের একটি প্রতিনিধিদল।

এদিকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একযোগে গুচ্ছ বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে ইউজিসি। ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় উপাচার্যদের সঙ্গে ইউজিসির সভায় এ নীতিমালা উপস্থাপন করা হবে। ভর্তি পরীক্ষার খসড়া প্রস্তাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হবে। আর ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া হবে অনলাইনে। দেশজুড়ে একযোগে দুই দিনেই শেষ হবে সব পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান থাকবেন ইউজিসির সদস্য অথবা বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। অন্য ভিসিরা সদস্য হিসেবে থাকবেন। ভিসিদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হবে সদস্য সচিব। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটিতে প্রশাসনিক এবং কারিগরি কমিটি গঠন করা হবে। ভর্তি প্রক্রিয়া শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসনসংখ্যা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হবে। তার ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি করা হবে।

খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, উভয় কমিটির কয়েকজন সদস্য মিলে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি, ভিন্ন ভিন্ন গুচ্ছের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদনপত্র আহ্বান ও যাচাই-বাছাই, শিক্ষার্থীদের নামের পাশে কোড দেওয়া ও মেধাতালিকা তৈরি করবে। এছাড়া স্থানীয় কমিটিতে খাতা দেখা, ফলাফল প্রক্রিয়ায় সাব-কমিটি গঠন করা হবে। কড়া নিরাপত্তার মাধ্যমে পরীক্ষা আয়োজন করা হবে। পরীক্ষা গ্রহণের আগে এসব কমিটি গঠন করা হবে। অন্যদিকে স্থানীয় কমিটি পরীক্ষা নেওয়া, খাতা মূল্যায়নে কোডিং, ফল প্রণয়ন প্রক্রিয়াকরণ ও তা যথাস্থানে পাঠানোর কাজ করবে।

গতকালকের সভায় ক্যাব সভাপতি বলেন, সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত ইউজিসির পদক্ষেপকে আমরা সাধুবাদ জানাই। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে ইউজিসি দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাবে।

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বৈঠকে বলেন, সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে খুবই অনীহা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের। এতে নাগরিক অধিকার বিপন্ন হচ্ছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ। ইউজিসি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করে দিলে ক্যাব সেটি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচষ্টা চালাবে।

সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান প্রফেসর কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আমাদের জন্য একটি ‘ব্রেক থ্রু’ এনে দিয়েছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে সবার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি। এক্ষেত্রে সবার অব্যাহত সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।

ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, সবাই চাচ্ছে সমন্বিত পদ্ধতিতে এবারে ভর্তি পরীক্ষা হোক। তিনি প্রশ্ন রাখেন, পশ্চিমা বিশ্ব যদি কেন্দ্রীয়ভাবে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারে  আমরা কেন পারব না? সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা দৃঢ়। এটি বাস্তবায়নে কোনো ছাড় নেই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি অপারগ হয় সে ক্ষেত্রে তাদের ছাড়াই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, আমরা প্রথমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি বাস্তবায়ন করব। পর্যায়ক্রমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হবে।

সভায় সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, দেশে অপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। কোথায় মানসম্পন্ন, দক্ষ শিক্ষক পাবে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। বুঝতে হবে উচ্চশিক্ষা নাগরিকের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার নয়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আজ অরাজকতা চলছে। কেউ কেউ সার্টিফিকেট বাণিজ্য করছে। ফলে মেধাবী ও দক্ষ গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে না। উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করা অনুচিত।

প্রসঙ্গত, গত ২৩ জানুয়ারি সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা করে ইউজিসি। ওই সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads