• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
মুজিবনগর সরকারের নেপথ্যে

ছবি : সংগৃহীত

মুক্তমত

মুজিবনগর সরকারের নেপথ্যে

  • মো. জোবায়ের আলী জুয়েল
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৯

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথচলায় যে কয়টি তারিখ নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে, নিঃসন্দেহে ১৭ এপ্রিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ নেওয়ার দিন। নিঃসন্দেহে ১৭ এপ্রিল তারিখটি স্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে ঐতিহাসিক।

২৫ মার্চ রাতেই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। ৩ এপ্রিল দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠককালেই তাজউদ্দীন আহমদ মনস্থির করেছিলেন, সংগ্রাম সফল করতে হলে আইনানুগ সরকার গঠনের বিকল্প নেই। সরকার গঠিত না হলে বহির্বিশ্বের সহায়তা পাওয়া যাবে না। মার্চে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও চার সহসভাপতিকে নিয়ে হাই কমান্ড গঠন করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ঠিক করলেন, তারাই হবেন সরকারের প্রধান কাণ্ডারি। দিল্লি থেকে ফিরে তিনি দলের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতার খোঁজে বের হন, কেউ কেউ তখন কলকাতায় পৌঁছে গেছেন।

১০ এপ্রিল বলা যায়, তার একক উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠিত হলো। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম হলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সরকারের অন্য সদস্যরা হলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (অর্থ), খন্দকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র ও আইন) এবং এএইচএম কামরুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন)।

তাজউদ্দীন আহমদ সব শ্রেণির মতের ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক ও সামরিক কাঠামো। বিলম্বে হলেও সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনও ছিল তাঁঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয়। পৃথিবীতে মাত্র দুটি দেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র আছে, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১০ এপ্রিল ছয় সদস্যের সরকার গঠনের পাশাপাশি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও জারি হয়। পরদিন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। এই প্রথম দেশ ও বিদেশের মানুষ জানল, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। পাকিস্তান সরকার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্ব নেই, এটি কেবল ভারতের প্রচারণা। সে কারণেই শপথ গ্রহণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননকে। এলাকাটির তিন দিকেই ভারত। তাই পাকিস্তানি বিমান হামলার আশঙ্কা ছিল না।

১৬ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে এসে বাংলাদেশ সরকারের দুই প্রতিনিধি আবদুল মান্নান ও আমীর উল ইসলাম শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানান। নির্ধারিত সময়ে এসেছিলেন সাংবাদিক, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তারা, এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) আতাউল গণি ওসমানী। এরপর এলেন ইপিআর ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা। এলেন আশপাশের এলাকা থেকে কয়েক হাজার মানুষ। প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত হলো। তারপর বাংলাদেশের মানচিত্র শোভিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হলো। স্থানীয় চার তরুণ গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ জাতীয় পরিষদের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী মুহুর্মুহু স্লোগান ও করতালির মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ এবং শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন।

শপথ গ্রহণের পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে নবগঠিত রাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেন এবং প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে আট পৃষ্ঠার একটি বিবৃতি পাঠ করেন। মুক্তিসংগ্রামে বিশ্ববাসীর সহায়তার আহ্বান জানালেন। এরপর তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সাংবাদিকরা জানতে চান, বাংলাদেশের রাজধানী কোথায়? জবাবে তিনি বলেন ‘মুজিবনগরে’। মুজিবনগর ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। যুদ্ধকালীন সরকার নয় মাস এই মুজিবনগরেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। নিয়েছে দেশ গঠন ও উন্নয়নের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads