• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
এই ফাল্গুনে, ভালোবাসার উৎসবে

সংগৃহীত ছবি

মুক্তমত

এই ফাল্গুনে, ভালোবাসার উৎসবে

  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

রেজাউল করিম খোকন

ভালোবাসা নিয়ে কত কথা বলে মানুষ। এ নিয়ে নাটক কিংবা সিনেমা হচ্ছে হরদম। গল্প-উপন্যাসেও ভালোবাসা ভাবনার কমতি নেই কোথাও। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে কোনোভাবেই নিজের গল্পটাকে মেলাতে পারে না কেউ কেউ। ভালো লাগার এই বোধ, ভালোবাসার এ শিহরণ যে একান্তই তার নিজস্ব। সে শুধু জানে কী করে ভালোবাসতে হয়। ভালোবাসতে হয় দিগন্তরেখায় এক হয়ে যাওয়া কিছু সমান্তরাল স্বপ্নকে। প্রেম এমন এক ধরনের আগুন যা ইচ্ছে করলেই লাগানো যায় না, আবার ইচ্ছে করলেই নেভানো যায় না। একবার যদি তা জ্বলে ওঠে তখন তা জ্বলতেই থাকে। আবার নিভে গেলে শত চেষ্টাতেও তাতে স্ফুলিঙ্গ ধরে না। ভালোবাসা, প্রেম আর বিরামহীন পথচলার যেমন শেষ নেই আর ভালোবাসার পাঠসূত্র মেনে রোমান্সের উড়াল ঘুড়ির উড়তেও কোনো বাধা নেই। নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে কেউ ভালোবাসে না। ভালোবাসলে অন্ধকারে আলো দেখা যায়, পুরো রোমান্সের সাগরে ডুবে গেলে দুঃখের মাঝেও সুখের বসত গড়া যায়। সেই প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত প্রেমের আকুতি, ভালোবাসার যে আবেদন তা একটুও পাল্টায়নি। শুধু সময়ের ব্যবধানে পাল্টে গেছে এর প্রকাশভঙ্গি। ভালোবাসার বোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একাধিক অনুষঙ্গ। মিডিয়ার কল্যাণে আর গ্লোবালাইজেশনের ডামাডোলে রোমান্সে বিভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। তবু ভালোবাসা হার মানতে জানে না বলেই পাল্টে যাওয়া সময়ের নানা অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে ঠিকই খুঁজে নেয় তার পথ। ভালোবাসার উপহার বা কার্ডের মধ্য দিয়ে প্রেমের প্রাকৃতি পৌঁছে যায় এক হূদয় থেকে আরেক হূদয়ে। তবে এতো কিছুর ভিড়েও চূড়ান্ত শক্তি কিন্তু ভালোবাসাই। তাই উপহার বা কার্ড ভালোবাসা প্রকাশের প্রতীক হতে পারে। কিন্তু সত্যিকার ভালোবাসার তুলনা শুধু ভালোবাসাই। যে ভালোবাসে আর যাকে ভালোবাসা হয় দুজনেই ভালোবাসার উপলক্ষ খোঁজে। দুনিয়া জুড়ে ভালোবাসা দিবস সেই উপলক্ষ মাত্র।

জীবনের পথচলায় প্রতিটি মানুষ ভালোবাসে অন্য অনেক মানুষকে। ভালোবাসে বাবা-মাকে, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে। এর মধ্যে অনেক সম্পর্ক হয় ক্ষণস্থায়ী। আবার এমন অনেক সম্পর্ক আছে যা কেবল ভালোবাসাকে পুঁজি করে মনের মাঝে আঁচড় কেটে চলে সারাজীবন। একটা সময় ছিল যখন ভালোবাসা প্রকাশে যেমন অনেক দ্বিধা সঙ্কোচ আর ইতস্ততা ছিল, তেমনি সামাজিকভাবে ব্যাপারটি এড়িয়ে চলাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। এখন মনের কথা বলতে একরকম ব্যাকুল তরুণ প্রজন্ম। তাই তো এখন ঘটা করেই পালিত হয় ‘ভ্যালন্টাইন’স ডে’ মানে ভালোবাসা দিবস। জগতের সবকিছুকে পেছনে ফেলে মানুষ এখন ভালোবাসার পেছনে ছুটতে প্রস্তুত। আমরা যারা ভালোবাসি কিংবা যারা ভালোবাসি না, তাদের প্রত্যেকের মাঝেই কিন্তু  ভালোবাসার বসবাস থাকে। এই বসবাসের ভেতরই রচিত হয় ভালোবাসার স্বপ্নগাথা। ভালোবাসার এমন কিছু ভাবনা থাকে যা সময়ের দোলাচলে কখনো কখনো পরিবারের কিংবা বন্ধু-বান্ধবদের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। দুটি মনকে এক সুতোয় নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন বেশ কিছু সরল বিশ্বাসের। কেউ যদি ভালোবাসার প্রতি একজন আবেগী অনুভূতিশীল মানুষ হন তবে নিচের কিছু সরল সত্য তাকে বিশ্বাস করতেই হবে। ভালোবাসা সবসময় ভাগ্যের ওপর নয় বরং ভালোবাসা সাহস, আত্মবিশ্বাস, পারস্পরিক সমঝোতা, অন্যের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষটিকে বোঝার ওপর নির্ভর করে। তাকে না পেলে জীবনটা বৃথা হয়ে যাবে, এমনটি না ভেবে ভালোবাসা ভাবতে শেখাক জীবনের বাস্তবতা। অকপটে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন নিজের মনের কথা। খোলা মনে আলাপ করতে হবে তার সাথে। ভালোবাসার অসংখ্য কারণের সঙ্গে নিজের ভেতরের বৈপরীত্যগুলো বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং আরো বেশি বিশ্বাস নিয়ে তার প্রত্যাশা মতো নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। ভালোবাসায় সততা সবচেয়ে বড় ব্যারোমিটার। তাই আপনার ভেতরের সৎ মানুষটিকে কখনো ডুবে যেতে দেওয়া চলবে না। স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে নয়, তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বর্তমানকে ভালোবাসতে হবে, কল্পনাকে নয়। ভালোবাসায় জয়ী হওয়ার আগে ভালো বন্ধু হতে হবে। কেননা একজন বন্ধুই পারে সত্যিকার ভ্যালেন্টাইন হতে। ভালোবাসার পক্ষভেদ হয় না, কিন্তু  ভালোবাসার ধরন বদলে যেতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রে যা ভাবনার বিষয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়তো তা নয়। এই যুগে এসে ফেসবুক, রং নাম্বার, ক্রস কানেকশন, এসএমএস, ইয়াহু, চ্যাটিং কিংবা রাস্তায় হঠাৎ দেখাতেও প্রেমের দোলা ছোঁয়া দেয় যে কারো মনে। তবে সেই দোলায় দুলে ওঠার আগে ভেবে নেওয়া উচিত। ভেবে নেওয়া উচিত অনেক কিছুই। মানুষ মাত্রই ভালোবাসা চায়। চায় ভালোবাসার মাঝে বেঁচে থাকতে। আর তাই নিজে ভালোবাসে অন্যকে বিশেষভাবে স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে। কিন্তু  অনেকেরই বিয়ের পাঁচ-দশ বছর পর মনে হয় তারা বুঝি ভুল করেছেন। সবকিছু থেকেও মনে হয় কী যেন নেই। অনেকে নীরবে এ পরিস্থিতি মেনে নেন। আবার অনেকে ভিন্নপথে চলতে শুরু করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, শুধু যৌন অতৃপ্তির জন্য কোনো নারী বা পুরুষ পরপুরুষ বা পরনারীতে আসক্ত হন না। প্রতিটি নারী বা পুরুষ চায় আরো বেশি কিছু। রোমান্স, হাসি, আনন্দ আর ভালোবাসা সম্মানে জড়িয়ে রাখুক সারাক্ষণ তা কাছে বা দূরে যেখানেই থাকুক সে।

অনেকেই মনে করেন, বিয়ে মানেই রোমান্টিক স্বপ্ন, ফুল আর ভালোবাসার মিষ্টি গল্পে পরিপূর্ণ। তারা মনে করেন প্রেমে পড়াই বিয়ে নামক সুখের সাগরে ভাসার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তাদের অনেকেরই এ স্বপ্ন ভেঙে যায়, যখন দেখেন বিয়ে নামক সম্পর্ককে সফল করতে প্রয়োজন সমঝোতা, পরস্পরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আর অনেক বেশি পরিমাণে সেক্রিফাইজিং মনোভাব। ভালেবাসা ছাড়া জীবনের কথা ভাবা যায় না। ভালেবাসাকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন আবর্তিত হয়। ভালোবাসাকে এড়িয়ে জীবনযাপনও সম্ভব নয়। ভালোবাসা একটি বিমূর্ত বিষয়। এই পৃথিবীতে কেউই একা নয়। সবার জীবন এক বহতা নদীর মতো বয়ে চলে। জীবনপথে চলতে চলতে সব মানুষই একজন সঙ্গীর প্রয়োজন অনুভব করে। এমন এক সঙ্গী যার সঙ্গে শেয়ার করা যায় জীবনের সব অনুভূতি। সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই মানুষ প্রেমে পড়ে। এই প্রয়োজনীয়তা এই অনুভব প্রকৃতি প্রদত্ত, সহজাত এবং চিরন্তন। যাপিত জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকের কাছেই ধরা দেয় প্রেমের বারতা। এই পৃথিবীতে প্রেমের এমন কিছু নিদর্শন রয়েছে যা আটপৌরে সাধারণ গতানুগতিক জীবনের গণ্ডিকে ছাড়িয়ে সব মানুষের মুখে মুখে ফেরে প্রেমের অমর গাথা হয়ে। রোমিও-জুলিয়েট, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমগাথা যুগে যুগে প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলকে অনুপ্রাণিত করেছে, প্রেমের জন্য ত্যাগ স্বীকারে সাহস জুগিয়েছে। আর তাই তো বরাবরের মতো ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে ভালোবাসার উৎসবে মেতে উঠবে সবাই আবারো। এত যান্ত্রিকতার মাঝেও ভালোবাসার বিচিত্র আনুষ্ঠানিকতায় মেতে উঠবে অনেক রোমান্টিক জুটি। দিনটিকে বর্ণাঢ্য, মিষ্টি অনুভূতিতে জড়ানো এবং স্মরণীয় করে তুলতে দুজনে মিলে কত বিচিত্র পরিকল্পনা করেছেন হয়তো-বা, কিন্তু ভ্যালেন্টাইন’স ডে’র একটি দিনের মধ্যে ভালোবাসার আনুষ্ঠানিকতার ডামাডোলে হূদয়ের একান্ত আবেগ অনুভূতিগুলোকে সীমাবদ্ধ করে ফেলার কোনো মানে হয় না। একটি দিন নয়, বছরের সব দিনেই ভালাবাসার রঙে রাঙিয়ে তোলা উচিত প্রত্যেকের জীবন। ভালোবাসা বলতে আমরা সাধারণত শুধু প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের সম্পর্ককেই বুঝে থাকি। আসলে কিন্তু তা নয়, এই পৃথিবীতে যে কাউকেই ভালোবাসা যায়। সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা, ভাই-বোনের ভালেবাসা, মা-বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা ইত্যাদিতে ভালোবাসা বিচিত্ররূপে প্রকাশিত হয়। ভালোবাসা অনেক পবিত্র একটি অনুভূতি। ঠিক তেমনিভাবে প্রেমও পবিত্র। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে অহেতুক ছলনা মোটেও উচিত নয়। এ নিয়ে প্রতারণাও মহাপাপ। স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সত্যিকার ভালোবাসা হয় না। প্রেম হচ্ছে পৃথিবীর মধুরতম সম্পর্ক যেখানে থাকবে না স্বার্থ আর লোভের উপস্থিতি, থাকবে শুধুই ভালোবাসা।

ফাল্গুন এলে প্রকৃতিতে ভালোবাসার গুঞ্জন শুরু হয়। রঙ রূপ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। বহুরঙা নিসর্গ ছুঁয়ে যায় মন। ফাল্গুন আর ভালোবাসা যেন এক সঙ্গে গাঁথা। ফাল্গুন মানেই ভালোবাসার বর্ণিল রঙছটা। সেই রঙে মনের মধ্যেও ভালোবাসার জোয়ার জাগে। ভালোবাসার নেশায় ডুবে গিয়ে বুঁদ হতে কোনো বিশেষ দিন লাগে না। প্রতিদিন প্রতি প্রহরে প্রাণের মানুষটির জন্য হূদয়ে কেমন করে ওঠাটাই ভালোবাসার প্রকাশ। প্রিয় মানুষটির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যেই ভালোবাসার সার্থকতা। এবারের ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে আমাদের সবার অঙ্গীকার হোক-ভালোবাসার জোয়ারে আমরা মনের সব দুঃখ-গ্লানি, কলঙ্ক, পাপ, অভিশাপমুক্ত হবো, স্বার্থপরতা, নীচতা, পাশবিকতা, কুসংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবো, ভালোবাসার মিষ্টি আবেগে জড়িয়ে রাখার চেষ্টা করব সব ধরনের সম্পর্ককে, ভালোবাসার ছোঁয়ায় জীবনের সৌন্দর্যকে আরো উজ্জ্বল প্রাণবন্ত অর্থবহ করে তুলব। এর মাধ্যমেই ভালোবাসা দিবস যথার্থ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে সবার কাছে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও মুক্তগদ্য লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads